বরফাচ্ছাদিত তুন্দ্রা অঞ্চলের যত গাছ সবই কিন্তু লম্বায় খাটো, অধিকাংশই এক ফুটের চেয়ে কম। বড় গাছ হওয়ার জন্য শিকড়ের যে ব্যাপ্তির দরকার হয় তা এদের নেই। কেন নেই তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি– এর পেছনে রয়েছে পারমাফ্রস্ট বা হিমজমাট মাটির অস্তিত্বের কথা। সাধারণ মাটির সঙ্গে হিমজমাট মাটির কোনো বিশেষ তফাত নেই, মাটিকে রেফ্রিজারেটরে রাখলে যা হয়, অনেকটা সেই রকম। প্রায় সারা তুন্দ্রায় এদের অবস্থান, যা উত্তর গোলার্ধের প্রায় ২৫ শতাংশ। এই মৃত্তিকা-স্তরের পুরুতার কোনো ঠিক নেই, কোথাও এক মিটার আবার কোথাও বা এক কিলোমিটারও হতে পারে। তবে যত পুরুই হোক মেরু-গ্রীষ্মে এই স্তরের ওপরের সামান্য অংশেরই বিগলন হয়ে থাকে।

এই বিগলিত অংশটা দেখতে ফ্রিজ থেকে বের করে রাখা মাংসের মতো, গলে জল হচ্ছে না কিন্তু নরম স্পঞ্জি হয়ে পড়ছে। এই স্পঞ্জি স্তরের ওপরেই যাবতীয় তুন্দ্রা-গাছগাছালির জন্ম হয়। ওপর থেকে ফুটখানেক বা গজখানেক হয়তো বিগলিত হয় কিন্তু নিচে থাকে কঠিন হিমজমাট মাটি। উষ্ণতায় গলে যাওয়া এই মাটি তরলের কাছাকাছি অবস্থায় গেলেও কিন্তু হিমজমাট স্তর ভেদ করে নিচে যেতে পারে না; যে কারণে বৃষ্টিপাতের জন্য সৃষ্টি হয় ছোট-বড় নানা আকৃতির জলাশয়। গাছের শিকড় এই শক্ত জমাট স্তর ভেদ করে নিচে যেতে পারে না; তাই বড় গাছ জন্মাতে পারে না মেরুতে।

এখন পৃথিবীবাসীর জন্য দুঃসংবাদ হলো, হিমজমাট স্তর বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। গলে যাওয়ার কারণে সংরক্ষিত গাছের শরীর পচে গিয়ে গ্রিন হাউস গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন তৈরি হচ্ছে। ২০ বছরের ব্যবধানে এই মিথেন গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ৮৪ গুণ বেশি হতে পারে; যার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আরও বাড়বে, আরও বেশি করে গলে যাবে হিমজমাট স্তর। আগে ধারণা করা হতো, হিমজমাট স্তর পৃথিবীর একটি বিশাল আকৃতির কার্বন স্টোর। এখন উল্টো নিয়মে মনে হচ্ছে– এটা কার্বনের একটা বড় রকমের উৎস তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য একটি যুৎসই উপাদান।

এই গলনের কারণে বিশ্বজুড়ে হিম অঞ্চলে দেখা দিয়েছে নানা বিভ্রাট, যা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। উত্তর কানাডা, আলাস্কা ইত্যাদি অঞ্চলে যেসব বাড়িঘর নির্মিত হয়েছিল এই জমাট স্তরের ওপরে সেগুলো কাত হয়ে ঢলে পড়ছে, ঢলে পড়ছে বড় গাছের কিছু বনাঞ্চলও। রেললাইনগুলো এমনভাবে ওপর নিচে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে রোলার কোস্টারের দোলার জন্য তৈরি হয়েছে এই রেল। পশ্চিম সাইবেরিয়ায় কোনো কোনো জায়গায় হিমজমাট মাটির স্তর পরিপূর্ণ গলে যাওয়ার কারণে গলিত তরল নিচে প্রবিষ্ট হচ্ছে; ফলে লেকগুলো জলশূন্য হয়ে পড়ছে। স্যাটেলাইট থেকে এই জলশূন্যতা খুব স্পষ্টভাবে অবলোকন করে বিজ্ঞানীরা শিউরে উঠছেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উচ্চতায় নির্মিত হয়েছে অভূতপূর্ব কিঙ্গাই-তিব্বত রেলপথ, যা তিব্বত ও চীনের ভেতর যোগাযোগ রক্ষা করে। সেখানে দেখা দিয়েছে এক নতুন সমস্যা। এই রেলপথের কিছু অংশ নির্মিত হয়েছে পারমাফ্রস্ট বা হিমজমাট মাটির ওপরে। খুব দ্রুত এর ব্যবস্থা না নিলে এর অবস্থা হবে উঁচু-নিচু রোলার কোস্টার ট্রাকের মতো। নিরাপত্তার কারণে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। এই স্তর গলে যাওয়ার কারণে কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে ল্যান্ডস্লাইড বা ভূমিধস। হিমজমাট মাটির স্তর গলে গেলে অনেক সংরক্ষিত বীজ থেকে জন্ম নেবে হাজার হাজার বছর আগেকার পুরোনো উদ্ভিদ। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছুদূর এগিয়েছেন। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের বিজ্ঞানী ডেভিড গিলিচিনেস্কি বরফের নিচে হিমজমাট স্তর থেকে তুলে আনা ফলের টিস্যুর ওপর গবেষণা করেছেন।

এই ফল পাওয়া গেছে সুড়ঙ্গ করা কাঠবিড়ালির বাসা থেকে। তিনি ফলের টিস্যুতে গ্রোথ হরমোন আরোপ করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিকড় বের করতে পেরেছেন এবং সেল-ডিভিশন ঘটাতে পেরেছেন। জন্ম হয়েছে নতুন গাছের; তাতে ফুল এসেছে, ফলও ধরেছে। এ গাছের দ্বিপদী নাম দেওয়া হয়েছে সায়লিন স্টেনোফিলা। রেডিওকার্বন ডেটিং থেকে জানা গেছে, গাছটি কমপক্ষে ৩০ হাজার বছরের পুরোনো। কানাডা ও আলাস্কার হিমজমাট স্তরে পাওয়া গেছে আরও কিছু কাঠবিড়ালির ফসিল-বাসা, যার থেকে হয়তো পাওয়া যাবে বহুকাল আগের উদ্ভিদ ও তাদের পরিবেশ সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারে চমৎকৃত হলেও তারা কিন্তু সততার সঙ্গে একটি বিষয় ভেবে দেখছেন, সুপ্তি থেকে জেগে ওঠা অতি পুরোনো উদ্ভিদ বর্তমান পৃথিবীর জন্য কোনো প্রকার হুমকিস্বরূপ কিনা।

বিষয় : হিমজমাট মৃত্তিকা

মন্তব্য করুন