সাক্ষাৎকার: তানভীর এ মিশুক
ক্যাশলেস সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক বাজেট প্রয়োজন
ডিজিটাল ব্যাংক বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনবে

তানভীর এ মিশুক
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪ | ০০:৩০ | আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ | ১৬:০০
দেশে ক্যাশলেস লেনদেনের ফলে একই টাকা দিনে কয়েকবার লেনদেন করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বাড়তি গতি আনা, লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যাংক বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন নগদ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর এ মিশুক। তিনি বলেন, অনেক সমস্যা আর চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সামনের দিনে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার নাম হবে ডিজিটাল ব্যাংক। তবে সময়োপযোগী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি-সহায়তা খুবই জরুরি। আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নগদের সিইও এমন মত দেন।
তানভীর এ মিশুক বলেন, ‘আগামী জুলাই মাসে ডিজিটাল ব্যাংকের যাত্রা শুরু হবে। সঠিক নীতি-পরিবেশে ডিজিটাল ব্যাংকের যাত্রা শুরু করা গেলে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সহজতর হবে। আসন্ন বাজেটেই এ-সংক্রান্ত নীতি-সহায়তার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস করার ঘোষণা দিয়ে সরকারের দিক থেকে সঠিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এখন এই পথে এগিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন বাধা দূর করে পথটাকে মসৃণ করতে হবে। কিছু বিষয় হয়তো সরাসরি বাজেটে আসবে না। পরবর্তী সময়ে সরকারকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। তবে ইঙ্গিতটা বাজেটেই থাকা জরুরি।’
নগদের সিইও আরও বলেন, আসন্ন বাজেটে সবচেয়ে বড় কাজ হতে পারে দেশে ডলার প্রবাহ বাড়াতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার ওপর জোর দেওয়া। শুধু রেমিট্যান্স বৈধ পথে আনার মাধ্যমেই সমস্যার অর্ধেক সমাধান করা যাবে। তাহলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে দেশের অবস্থান আরও শক্ত হতো এবং রিজার্ভেও সরকারকে হাত দিতে হতো না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, মোট রেমিট্যান্সের অর্ধেকটাও বৈধ পথে আসে না। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এই অর্থ বৈধ পথে আনতেই হবে। আর এ ক্ষেত্রে সহজ পথ হবে ডিজিটাল ব্যাংক। ডিজিটাল ব্যাংক বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনা বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে এখানেও সরকারের নীতি-সহায়তা খুবই জরুরি।
তানভীর এ মিশুক মনে করেন, টাকা তো বহুকাল থেকেই বিনিময়ের মাধ্যম, যা দিয়ে আমরা অনেক কাজ ও সেবার খরচ মেটাই। কিন্তু টাকারও তো ব্যবস্থাপনা, ছাপাসহ নানান দিকে খরচ আছে। শুধু টাকা ছাপতেই বছরে ৯-১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণায় এমন তথ্য মিলেছে। তবে ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিত করতে পারলে প্রতিবছর অন্তত এই পরিমাণ খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশে কোনো নীতি প্রণয়ন হলে তার মানোন্নয়নে অনেক সময় চলে যায় উল্লেখ করে তানভীর বলেন, এই সেদিন চ্যাটজিপিটি চালু হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে তারা তাদের নীতিমালা তিনবার বদলেছে। সময়ের সঙ্গে চলতে হলে এমন করতেই হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এটি বিবেচনায় নিতে পারেন।
রাজস্ব সংগ্রহ প্রসঙ্গে নগদের সিইও বলেন, সরকার পরিচালনার জন্য কর অবশ্যই দরকার। কিন্তু প্রয়োজন বা অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে এসব বিষয়ে সরকারকে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্যাশলেস লেনদেনকে কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, গ্রাহকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হলেও ট্যাক্স রিবেট দেওয়া যেতে পারে। সামান্য এই কাজটাই কিন্তু ক্যাশলেস লেনদেনকে অনেকটা পথ এগিয়ে দেবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তানভীর বলেন, ডিজিটাল লেনদেনে সামগ্রিক করের বোঝা অনেক বড়। করপোরেট ট্যাক্স ছাড়াও গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ব্যবসায় পর্যায়ে ১২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর নগদের মতো ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।
সরকারি ফি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্যাশলেস ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করার সময় হয়েছে উল্লেখ করে তানভীর এ মিশুক বলেন, ‘যে যাই বলুক না কেন, এখনও প্রযুক্তি সেবার জন্য আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট নলেজ খুবই জরুরি। ফলে এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কিছু ট্যাক্স সুবিধা দেওয়ার পক্ষে আমি।’ তাঁর মতে, ‘বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে বিনিয়োগকারীদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ সহজ করতে হবে। বিনিয়োগ করা যেমন সহজ, তুলে নেওয়া আরও সহজ– এমনটা যদি আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীকে দেখাতে না পারি, তাহলে তারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাবে না। আমাদের এটা ভাবতে হবে।’
তিনি যোগ করেন, ফিনকেট কোম্পানিগুলো তো শুধু ব্যবসা করে না, দেশ-সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটাই করে। এ ক্ষেত্রে সরকার বরং একটু সুদূরপ্রসারী হয়ে কিছুদিনের জন্য এখানে খানিকটা ছাড় দিলে আরও কোটি কোটি মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত করা যায়। তাতে গোটা অর্থনীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শুধু আর্থিক খাতকে স্মার্ট প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে পারলেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার পথ মসৃণ হবে– মন্তব্য করে তানভীর এ মিশুক বলেন, ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার ১ শতাংশ ছাড় দিলে জাতীয় অর্থনীতিতে ৫ শতাংশের বেশি রিটার্ন আসবে। এই দিকটা নীতিনির্ধারকদের নজরে আসা দরকার।
গ্রাহকদের আরও বেশি ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করতে সরকারের তরফ থেকে ডিজিটাল লিটারেসি প্রোগ্রাম করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের ওপর জোর দেন তানভীর। তাঁর মতে, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় অটোমেশন ছাড়া এগোনোর সুযোগ নেই। সে জন্য সমন্বিত একটি প্রক্রিয়ার ওপর গোটা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাছাড়া পরোক্ষ করনির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে। যারা কর দেয় তাদের ওপর বাড়তি চাপ না দিয়ে বরং পরিসর বাড়ালে রাজস্ব আদায় ফলপ্রসূ হবে বলেও মনে করেন তানভীর।
দেশের বাজেট-পূর্ব সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে তানভীর এ মিশুক বলেন, কয়েক বছর আগেও দেশের জাতীয় আয় বা জিডিপি সম্মানজনক জায়গায় ছিল না। অথচ এখন আমাদের সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। কয়েক বছরের মধ্যেই ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এশিয়ার টাইগারের খ্যাতি পাওয়া বাংলাদেশ প্রতি এক দশকে নিজেদের জিডিপি দ্বিগুণ করেছে। তার পরও গত কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ ও বাইরের কয়েকটি ইস্যুতে অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়ছে। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সঠিক দিকনির্দেশনায় সচেতনতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে।
ঘুরে দাঁড়ানোর এই পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বা নতুন উদ্ভাবন নিয়ে যারা কাজ করে, এমন উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা সরকারের দিক থেকে থাকা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের স্বল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান তানভীর।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার