অবস্থান বদলে যে কারণে ছাপানো হচ্ছে টাকা
.
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৪৩ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৫২
গত সরকারের সময়ে বড় অঙ্কের টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়ায় মূল্যস্ফীতি উস্কে দেওয়ার জন্য ব্যাপক সমালোচনা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ঋণ দিতে আর টাকা না ছাপানোর ঘোষণা দেয়। তবে চার মাস না যেতেই আগের অবস্থান বদল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ছয় ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে আরও টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর। হঠাৎ অবস্থান বদল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
দুর্বল কিছু ব্যাংক থেকে গ্রাহক ঠিকমতো আমানত তুলতে না পারায় পুরো ব্যাংক খাতের ওপর যেন আস্থাহীনতা তৈরি না হয়, সেজন্যই আগের অবস্থান বদলে টাকা ছাপানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা। এদিকে স্বল্প মেয়াদে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে ছয় ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার তথ্য জানান। তিনি বলেন, টাকা না ছাপানোর যে কথা তিনি বলেছিলেন, সেখান থেকে সাময়িক সময়ের জন্য সরে এসেছেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির যে ধারা ছিল, তা বজায় থাকবে। এক হাতে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হবে, আরেক হাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের বিপরীতে যাদের উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে, তাদের কাছ থেকে তুলে নেওয়া হবে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমানে একটা উভয় সংকটের জায়গা তৈরি হয়েছে। একদিকে ঠিক করলে আরেক দিকে সংকট তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে এসব দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সেখানে হয়তো খুব বেশি আগ্রহ পাওয়া যায়নি। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটানোর মতো অর্থ উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে আসেনি। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে আমানতকারীদের মধ্যে একটা আস্থাহীনতা ও আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। মুখে মুখে যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে চাহিদামতো টাকা তোলা যাচ্ছে না, তখন পদ্ধতিগত একটা ঝুঁকি তৈরি হবে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, প্রয়োজন মেটানো হবে। এতে করে বাজারে সাময়িকভাবে অর্থ সরবরাহ বাড়বে। তবে আবার সময়মতো টাকা তুলে নিতে হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্বল্প মেয়াদে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প ছিল না। অর্থ না দেওয়ার বিকল্প হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা নিষ্পত্তি করা। তবে সেজন্য সময় লাগবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাবের বিষয়টি নির্ভর করবে কী পরিমাণ অর্থ বাজারে ঢুকছে এবং কতদিন থাকছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি টাকা ইস্যুর বিষয়টি ‘মানি প্রিন্টিং’ বা ‘টাকা ছাপানো’ হিসেবে বিবেচিত। অবশ্য টাকা ছাপানোর মানে কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হচ্ছে, তেমন নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নির্ধারিত পরিমাণের টাকা স্থানান্তর করছে। চাইলেই কাগুজে নোট ছাপতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা, কোনো একটি বছরে কী পরিমাণ টাকা ছাপা হবে, বছরের শুরুতেই তা নির্ধারিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি টাকা দিলে মূল্যস্ফীতিতে তার প্রভাব পড়ে। তবে ব্যাপক মাত্রায় যেন প্রভাব না পড়ে, সেজন্য একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে উদ্বৃত্ত টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের পাশাপাশি দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে ৩০ দিন মেয়াদি দু’দিনের নিলামে ৯৩১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ১১ থেকে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে এ টাকা তোলা হয়েছে। ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের পাশাপাশি ৯০ ও ১৮০ দিন মেয়াদি বিল বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে টাকা রাখতে ব্যাংকগুলো যেন উৎসাহিত হয়, সেজন্য আরও আকর্ষণীয় সুদ দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময়ে সাতটি ব্যাংকের চলতি হিসাব ঋণাত্মক রেখে লেনদেনের সুযোগ দিলেও এখন তা বন্ধ হয়েছে। এসব ব্যাংক চাহিদামতো সাধারণ আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকগুলোকে সহায়তার জন্য সরাসরি টাকা না দিয়ে আন্তঃব্যাংক ধারের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তাতে তেমন সাড়া দেয়নি ভালো ব্যাংকগুলো। আবার ভেঙে ভেঙে টাকা পাওয়ায় তেমন কাজ হচ্ছে না। যে কারণে আমানতকারীর আস্থায় তেমন প্রভাব পড়ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মাত্র ৭ হাজার ৫০ কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছে। গ্রাহকদের চাহিদার তুলনায় যা অপ্রতুল। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীনতা প্রকট হচ্ছে। এ কারণে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোন ব্যাংককে কত ধার দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে চরম সংকটে পড়েছে সাতটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংককে ৫ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ৪ হাজার কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংককে ৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে ২ হাজার কোটি টাকা করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকও বিশেষ ধার চাইলে তাতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ছাড়া বাকি ব্যাংক ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণে।
জানা গেছে, ১০ শতাংশ সুদে এ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তদারকিতে থাকায় তাদের আশা শিগগিরই এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যাংকগুলো থেকে ছয় মাস পর থেকে প্রতি প্রান্তিকে ১ হাজার কোটি টাকা করে ফেরত নেওয়া হবে। অবশ্য বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে সময় বাড়াতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আস্থা বাড়ানোর জন্য আমানতকারীকে বোঝাতে হবে, যে কোনো অঙ্কের টাকা ফেরত দিতে এসব ব্যাংক সক্ষম।
- বিষয় :
- টাকা
- বাংলাদেশ ব্যাংক
- কেন্দ্রীয় ব্যাংক