শেয়ার কারসাজির হোতা হিরোকে ১৩৩ কোটি টাকা জরিমানা
আবুল খায়ের হিরো
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১৬ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৪২
তালিকাভুক্ত চার কোম্পানি– ফরচুন সুজ, সোনালি পেপার, এনআরবিসি ব্যাংক এবং ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরো, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৩৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সিদ্ধান্ত নেয়, যা গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে সংস্থাটি। আবুল খায়ের হিরো শেয়ারবাজারে কারসাজির অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত। তাঁকে এর আগেও জরিমানা করেছে বিএসইসি।
বিএসইসির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, তালিকাভুক্ত সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস কোম্পানির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজা ইউনুসসহ তিনজনকে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে প্রত্যেককে ২০ লাখ টাকা, মোট ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রাইম ফাইন্যান্স প্রথম নামের একটি মিউচুয়াল ফান্ডের দর নিয়ে কারসাজির দায়ে দুই ব্যক্তিকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আবুল খায়ের হিরো ৩১তম বিএসএস (সমবায়) ক্যাডার কর্মকর্তা। বর্তমানে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক হিসেবে কর্মরত। শেয়ার কারসাজিতে বিএসইসি যাদের জরিমানা করেছে, তাদের মধ্যে হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ছাড়াও ভাই, বোন ও শ্যালক রয়েছেন। সমকাল নিশ্চিত হয়েছে, পরিবারের সদস্যরা নিজেরা কেউ শেয়ার ব্যবসা করতেন না। পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলো নিজের শেয়ার কারসাজির জন্য ব্যবহার করেছেন হিরো।
সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-
উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন বিএসইসিও হিরো এবং তাঁর পরিবার সদস্যদের বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে জরিমানা করেছিল। অভিযোগ আছে, অধ্যাপক শিবলীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে কারসাজি করেছিলেন হিরো। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই সমকালে তাঁর শেয়ার কারসাজির আদ্যোপান্ত নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা যায়, হিরোর মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী নিজেও বেনামে শেয়ার ব্যবসা করেছেন। অভিযোগ আছে, কারসাজির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় হিরোকে বাদ দিয়ে প্রথমে পরিবারের সদস্যদের নামমাত্র জরিমানা করেছিলেন তিনি। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে দুই-তিনটি ঘটনায় হিরোকেও নামমাত্র জরিমানা করেছিলেন। অবশ্য শেয়ার কারসাজির দায়ে জরিমানা হওয়ার পরও স্বপদে বহাল আছেন সমবায়ের এ কর্মকর্তা।
কার কত জরিমানা
ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজির দায়ে হিরোসহ পরিবারের পাঁচ সদস্য এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কোঅপারেটিভকে মোট ৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ডেল্টা লাইফের কারসাজির ঘটনায় একই পরিবারের সাত সদস্য ও এক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা, এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজি নিয়ে সাত ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠানকে মোট পৌনে ৭ কোটি টাকা এবং সোনালি পেপারের শেয়ার কারসাজি নিয়ে ছয়জনকে পৌনে ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
আবুল খায়ের হিরোকে ব্যক্তিগতভাবে ১১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে সর্বাধিক ২৫ কোটি টাকা, বোন কনিকা আফরোজকে ১৯ কোটি টাকা, বাবা আবুল কালাম মাতবরকে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং পরিবার সদস্য সাজেদ মাতবরকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর ডিআইটি কোঅপারেটিভকে জরিমানা করা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
ডেল্টা লাইফের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় হিরোকে ১৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা, বাবা আবুল কালাম মাতবরকে ২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, বোন কনিকা আফরোজকে ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ঘটনায় সাজেদ মাতবরকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, কাজী ফুয়াদ হাসানকে ১ লাখ টাকা, মোহাম্মদ বাশারকে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং ডিআইটি কোঅপারেটিভকে ৮৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবরকে সর্বাধিক ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং হিরোকে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। স্ত্রীসহ অন্যদের জরিমানা করা হয়েছে ২৮ লাখ টাকা।
তবে বহুল আলোচিত সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস কোম্পানির শেয়ার কারসাজির দায়ে হিরো এবং তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যকে মাত্র পৌনে এক কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। এর মধ্যে তাঁর শ্যালক কাজী ফুয়াদ হাসান এবং কাজী ফরিদ হাসানকে ৩৫ লাখ টাকা করে মোট ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। হিরো, তাঁর বাবা, স্ত্রী ও বোন মিলে মোট ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অধুনালুপ্ত ওটিসি বাজার থেকে ২৭৩ টাকা দর নিয়ে ২০২০ সালের জুলাই মাসে তালিকাভুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২২ সালের মে মাসে দুই দফায় কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯৬০ টাকা ছাড়িয়েছিল। ক্রমাগত দর পতনের পর শেয়ারটির দর এখন ১৫০ টাকা। এ শেয়ার কারসাজির নেপথ্যে কোম্পানিটির মালিকপক্ষের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
জরিমানা প্রথমবার নয়
হিরো এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এর আগে বিএসইসি বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারে কারসাজির দায়ে কয়েক কোটি টাকা জরিমানা করেছে। ২০২২ সালের ১৯ জুন গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির অভিযোগে আবুল খায়েরের স্ত্রী এবং তাঁর সহযোগীদের ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই তারিখে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির দায়ে তাদের জরিমানা হয় ৯৫ লাখ টাকা। ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে। ২০২২ সালের ৬ জুলাই ফরচুন সুজ নিয়ে শেয়ার কারসাজির দায়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২ আগস্ট ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির দায়ে ৩ কোটি টাকা এবং ৩০ অক্টোবর আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার কারসাজির দায়ে তাদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে এসব জরিমানার অঙ্ক ছিল কারসাজি করে অর্জিত মুনাফার অতি সামান্য। ফলে কারসাজির দায়ে জরিমানার পরও সরকারি পদে বহাল থাকার পাশাপাশি আগের মতো কারসাজি করেছেন হিরো। এমনকি বিদেশে বিএসইসি আয়োজিত রোডশোতে বিএসইসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অংশ নেন তিনি।
- বিষয় :
- জরিমানা
- শেয়ারবাজার