উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে নতুন ভ্যাট
বিকল্প উপায়ে রাজস্ব বাড়ানোর সুপারিশ
ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৬:৫০ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১২:২৩
রাজস্ব আদায়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় যোগ হচ্ছে বাড়তি করের বোঝা। হঠাৎ ভ্যাট, সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন ধরনের কর বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাড়তি করের তালিকায় রয়েছে– ওষুধ, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, জুস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এলপিজি গ্যাস, বিমানের টিকিটসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবা। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, বর্তমানে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ। নতুন করে ৪৩ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তারা কর ফাঁকি বন্ধ বা অন্য কোনো কৌশলে রাজস্ব বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে ভ্যাট বাড়লেও সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে না বলে দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থনৈতিক বিষয় ও সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, তাতে জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের ওপর সব ভ্যাট শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির মূল ইন্ডিকেটর হচ্ছে চাল-ডাল ইত্যাদি।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, তিন তারকার ওপরের রেস্টুরেন্টে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে কারও খরচের ওপর ১০ টাকা যোগ হলে মনোবেদনার কিছু আছে বলে মনে হয় না। বিমান ভাড়ার ক্ষেত্রে ভ্যাট ২০০ টাকা বাড়ানো হচ্ছে। এটি কেউ দিতে পারবে না বলে মনে হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশেই এত কম ট্যাক্স নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হচ্ছে–সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর রাজস্ব ঘাটতি অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, তালিকায় থাকা ওষুধ, পোশাক, রেস্টুরেন্ট, মোবাইল ফোনসহ আরও অনেক কিছুই নিত্যপণ্য। তাছাড়া এগুলোর অজুহাতে অন্য অনেক পণ্যেরও দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজবেন ব্যবসায়ীরা। কারণ ব্যবসায়ীদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া উচিত। এখন কর বৃদ্ধির যৌক্তিক সময় নয়। এতে করে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনার সুযোগ ছিল।
তিনি আরও বলেন, অবশ্যই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু পরোক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার খুব সহজ পথে হাঁটল। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানো ও কর ফাঁকি বন্ধ করেও রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার ছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. লুৎফর রহমান সমকালকে বলেন, অতীতে অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট বৃদ্ধি খুবই
সীমিত ছিল। এত বড় মাত্রার হঠাৎ বৃদ্ধি আগে দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে জনগণ কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন ছিল। প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ৯০ টাকা থেকে ১২৩ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, আনুপাতিক হারে বাড়তি দামের ওপর ভ্যাট আদায় হচ্ছে। নতুন করে আবার ভ্যাট বাড়ানো হলে তা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১০ টাকা ভ্যাট বাড়লে পণ্যের দাম বাজারে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
আইএমএফের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব অন্যদের ওপর ছেড়ে দিলে উন্নতি সম্ভব নয়। তার মতে, ভ্যাট হার এক হওয়া ভালো। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রয়োজনী ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট প্রযোজ্য রয়েছে।
ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন সমকালকে বলেন, ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বাড়ানো জনগণের প্রতি অবিচার, যা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটি সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে কর বাড়ালে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতির চাপও আরও তীব্র হতে পারে। শুধু আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, করোনা মহামারির পর থেকে হোটেল-রেস্তোরাঁ খাত ভয়াবহ খারাপ সময় পার করছে। এ খাতকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে একটি গোষ্ঠী। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্য কোনো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। আগামীতে কী হবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়ানো মানে দেশকে আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। তাদের দাবি, ভ্যাট বাড়ানো তো যাবেই না বরং কমাতে হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়াতে করের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ফাঁকি রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ জন্য মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনা হচ্ছে। এসব সংশোধনীসহ মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া গত বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
সংশোধনীর মাধ্যমে সহজ পন্থায় ভ্যাট আদায় করতে এবারও এনবিআর মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট খরচকে বেছে নিয়েছে। চলতি বাজেটে মোবাইল ফোনের সম্পূরক শুল্ক এক দফা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। আবার বাড়িয়ে তা ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এলপিজি গ্যাস সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার খরচও বাড়বে। আগামীতে সব ধরনের হোটেলে খাবার খেতে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে, যা সরকার ভ্যাট হিসেবে আদায় করবে। বর্তমানে রেস্তোরাঁয় খেতে ৫ শতাংশ এবং হোটেলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ব্র্যান্ডের পোশাক কেনার খরচও বাড়বে। কারণ তৈরি পোশাকের ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আরও দাম বাড়বে গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, এইচআর কয়েল, সিআর কয়েল, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, টয়লেট টিস্যু, মিষ্টি, গাড়ির ওয়ার্কশপ, তাজা-শুকনা সুপারি, ফলের রস, তাজা ফল, সাবান-ডিটারজেন্ট, রং, সিগারেট, বিমানের টিকিট ইত্যাদির।
- বিষয় :
- ভ্যাট