১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ দুই লাখ কোটি টাকা
.
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:২১
দেশে এখন সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে দশ ব্যাংকেই রয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। মোট খেলাপির যা ৭১ শতাংশ। ব্যাংকিং খাতের ঋণের প্রকৃত অবস্থা বের করার যে উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে, তাতে আগামীতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের ঋণস্থিতি কমে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। বিপুল অঙ্কের ঋণের বড় একটি অংশই নানা অনিয়ম এবং জালিয়াতির মাধ্যমে কাগুজে কোম্পানিতে দেওয়া হয়েছে। একটি অংশ পাচার করেছেন প্রভাবশালীরা। ধীরে ধীরে এখন তা খেলাপির খাতায় যোগ হতে শুরু করেছে। যে কারণে সেপ্টেম্বর শেষে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। তিন মাস আগে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি দেখানো হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মানে গত বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। এমন এক সময়ে খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসছে যখন আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দিয়েছে। সংস্থাটি ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে।
খেলাপি ঋণের শীর্ষে কারা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে জনতা ব্যাংকে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের যা ৬৬ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ব্যাংকিং খাতের খেলাপির ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ১৭ হাজার ৫০১ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি দেখানো হয়। বিগত সরকারের সময়ে ক্রিসেন্ট লেদার, বিসমিল্লাহ, অ্যানটেক্সসহ বড় কয়েকটি জালিয়াতি ঘটে এ ব্যাংকে।
খেলাপি ঋণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ২৬ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৭২ শতাংশ খেলাপি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৮ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল খেলাপি। তৃতীয় অবস্থানে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির ২৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বা ৫৬ শতাংশ খেলাপি। গত বছরের ডিসেম্বরে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়। মোট ঋণের যা ছিল ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে এখন আলোচিত ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির ১৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ খেলাপি দেখানো হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ৬ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ খেলাপি দেখানো হয়। পঞ্চম অবস্থানে থাকা সোনালী ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে ১৬ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকে ১২ হাজার ৭৩৫ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ১২ হাজার ২১৮ কোটি, এবি ব্যাংকে ১০ হাজার ১১৬ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপিতে শীর্ষ ২০ ব্যাংকের তালিকায় আরও রয়েছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী, পদ্মা, ব্যাংক এশিয়া, আইএফআইসি, বাংলাদেশ কৃষি, গ্লোবাল ইসলামী, ইউসিবি, এক্সিম, সাউথইস্ট ও প্রিমিয়ার ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন শিথিলতা দিয়ে আসছিল। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ২০১৯ সালে নজিরবিহীনভাবে এক নির্দেশনায় বলা হয়, টানা ৬ মাস কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ বিবেচিত হবে না। সেই সুযোগ এখন সীমিত হয়েছে। এর বাইরে ঋণ পুনঃতপশিলে নানা শিথিলতা দেখানো হয়েছিল। করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখাতে বলা হয়। পরের বছর কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত ছিল। এখন এসব সুবিধা বন্ধ হয়েছে। উপরন্তু ব্যাংকগুলো যেন ভুল তথ্য দিতে না পারে, সে জন্য একের পর এক পরিদর্শন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
- বিষয় :
- ব্যাংক