ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

ঢাকা চেম্বার-সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রাক বাজেট আলোচনা

ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়লে কর আদায় বাড়বে

ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়লে  কর আদায় বাড়বে

আগামী বাজেট সামনে রেখে রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকা চেম্বার-সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর যৌথভাবে আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনা সভায় উপস্থিত অতিথিরা সমকাল

 সমকাল প্রতিবেদক 

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:৩৯ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:৫৪

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের চেয়ে কম। এ বাস্তবতায় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কর আদায় বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে করের হার না বাড়িয়ে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সহায়ক কর কাঠামো দরকার বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। 

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে গতকাল রোববার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের যৌথ আয়োজনে এক আলোচনায় এমন মত দিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৫-২৬ : বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান এবং এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু ও মীর নাসির হোসেন। 
বক্তারা বলেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়লে কর আদায় বাড়বে। যারা কর দেন, তাদের ওপর চাপ তৈরি না করে যারা দেন না, তাদের করের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তারা। নিয়মিত করদাতাদের হয়রানি না করার পরামর্শ দেন তারা। 

আয়কর ও ভ্যাট, শিল্প ও বাণিজ্য, আর্থিক খাত এবং অবকাঠামো– চারটি বিষয়ের ওপর ঢাকা চেম্বারের সুপারিশ উপস্থাপন করা হয় এবং এসব খাতের ব্যবসায়ীরা আলোচনায় অংশ নেন। চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে। সমকালের ফেসবুক পেজেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। সমাপনী বক্তব্য দেন সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী। 

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান বলেন, করহার খুব বেশি কমানোর সুযোগ নেই। তবে কোম্পানি লোকসান করলেও কর দিতে হয়, যা নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি করছেন। এখানে নতুন বাজেটে কিছু করার চেষ্টা থাকবে। তিনি বলেন, আমদানিতে শুল্কহার কমানো হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক শুল্কহার আরও যৌক্তিকীকরণ করা হবে। 
আবদুর রহমান বলেন, গত ৫০ বছর ঘাটতি বাজেট দিয়ে ঋণ নেওয়ায় সুদব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এনবিআরের কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে অটোমেশন করতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘অটোমেশন ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। আমরা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কর প্রদান মোবাইল অ্যাপে আনার জন্য কাজ চলছে। আগামী অর্থবছর থেকে যাতে ব্যক্তি আয়কর দাতারা সবাই অনলাইনে রিটার্ন জমা দেন, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। কোম্পানি করদাতাদেরও আমরা একই প্রক্রিয়ায় আনার চেষ্টা করছি।’ করদাতারা আগামী বাজেটে ইতিবাচক বার্তা পাবেন বলেও জানান তিনি। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কর ব্যবস্থা বৈমষ্যহীন করার চেষ্টা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে দেওয়া কর-অব্যাহতি নতুন বাজেটে কমানো হবে।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগকেন্দ্রিক মডেল অনুসরণ করতে হবে। ভিয়েতনাম এ পথে এগিয়েছে। আমাদের কর কাঠামোও হতে হবে বিনিয়োগকেন্দ্রিক। বিনিয়োগ ছাড়া কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে না। ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়লে কর আদায়ও বাড়বে। বর্তমান কর কাঠামোতে অসামঞ্জস্য রয়েছে। 
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক কর কাঠামো, আর্থিক খাত এবং পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে হবে। 

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে পাল্টা শুল্ক আরোপ ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের। সরকারের উচিত, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে একটি  টাস্কফোর্স গঠন করা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে নীতিমালা করা প্রয়োজন। দেশি হোক বা বিদেশি– বিনিয়োগকারীদের জন্য নীতির ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। কর আদায় কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা খুব জরুরি। 

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, এমন বাজেট হতে হবে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রসারে সহায়তা করে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ায়। বেসরকারি খাত যাতে উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারে, তার জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় বাজারেও চাহিদা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। 
আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রশ্ন করেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে বেসরকারি খাতের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, আর সরকারের ব্যয়ে সম্প্রসারণ নীতি কেন? রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। সরকারের আয় নিয়ে অনেক কথা বলা হয়, অথচ ব্যয় নিয়ে সবাই নীরব থাকেন। সরকারি ব্যয়কে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে। এ জন্য আইন করতে হবে। চুরি হয় ব্যয় করার সময়। 
সরকারি তথ্য-উপাত্ত প্রসঙ্গে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, এসব মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করতে হবে। কাগজে এক খোঁচায় যদি পরিসংখ্যান কমে বা বাড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের দরকার কী। এ ধরনের মিথ্যা কথা বলার জন্য সরকারকে দায়বদ্ধ করতে হবে। 

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে কঠোর থেকে আরও কঠোর করছে। এ কারণে ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কৃচ্ছ্র শুধু বেসরকারি খাতের জন্য নিলেই হবে না, সরকারের মধ্যেও কৃচ্ছ্র প্রয়োজন। আগামী অর্থবছরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগবান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাস্তবমুখী এবং সময়োপযোগী বাজেট প্রত্যাশা করেন তিনি। 

আয়কর ও ভ্যাট 
আয়কর ও মূসক ভ্যাট বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের প্রস্তাবে বলা হয়, বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ কমাতে করজাল বাড়াতে হবে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করে ঢাকা চেম্বার।    
এনবিআরের সদস্য (করনীতি) এ কে এম বদিউল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক। তবে সব প্রস্তাব একসঙ্গে বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 
আইসিএবির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দীন বলেন, কর আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়, তা অযৌক্তিক। তিনি কার্যকরী কর যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পরামর্শ দেন। অডিট সহজ করা এবং ন্যূনতম কর বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। 
ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এলডিসি উত্তরণের জন্য প্রস্তুত নন। তাই সরকারের আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।  

শিল্প ও বাণিজ্য
শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের প্রস্তাবে বলা হয়, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয় বাড়ানোর মাধ্যমে টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য কৃষি, চামড়া, ওষুধ শিল্প, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি এবং অন্যান্য উদীয়মান খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আসন্ন বাজেটে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। 
এ বিষয়ে আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, শিল্পকারখানা এক প্রকার বন্ধ। গ্যাস-বিদ্যুৎ ঠিকমতো নেই। এর মধ্যে বাজেটের আগেই কিছু ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। নতুন শিল্পকারখানা কীভাবে হবে। তিনি প্রস্তাব করেন, ডলারের বিপরীতে টাকার যতটুকু মান কমেছে, সেই হারে কর কমানো হোক। ব্যাংকের সুদের হার অবশ্যই কমাতে হবে। 
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশের তুলা সংরক্ষণাগার তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি আগামী বাজেটে পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত কৃত্রিম তন্তুর শুল্ক ও অন্যান্য কর কমানোর সুপারিশ করেন। বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকের চাহিদা ৭৫ শতাংশ। 

আর্থিক খাত 
ডিসিসিআইর অন্যতম সুপারিশ, ঋণের সুদহার কমানোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিকরণ করার সময়সীমা আরও ছয় মাস পেছানো। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারকে দেশ ও দেশের বাইরে শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুপারিশ করেন চেম্বার সভাপতি। 
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ব্যাংকের ওপর করহার অন্য খাতের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যাংকের কার্যকরী করহার ৫০ শতাংশের মতো। আর্থিক খাত শক্তিশালী করতে হলে করহার কমাতে হবে। 

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানোর সুপারিশ করেন। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে নানা অনিয়ম হলেও কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। জবাবদিহি না থাকায় শেয়ারবাজার ভুগছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. সায়েরা ইউনুস বলেন, সরকার অনেক সময় বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়। এর ফলে বেসরকারি খাতে অর্থায়ন কমে যায়। তাছাড়া টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। বাজেট প্রণয়নের সময় এসব বিষয়ে নজর রাখা উচিত।

অবকাঠামো উন্নয়ন
অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে ঢাকা চেম্বার পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ কমানোর সুপারিশ করে। এ বিষয়ে আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, অবকাঠামোতে বিনিয়োগের অর্থায়নের জন্য সরকার পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। আরেক সাবেক সভাপতি সবুর খান বলেন, ব্যবসায়ীরা কর দিতে চান। এর বাইরে ঘুষ হোক আর যাই হোক, অর্থ দিতে চায় না। কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সব ধরনের জ্বালানির একই করহারের সুপারিশ করেন। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যান্ড লজিস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ সড়ক অবকাঠামো ব্যবসাবান্ধব করার জন্য বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন। 
 

আরও পড়ুন

×