ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

পাচার করা অর্থ আপস রফায় ফেরত আনার বিধান হচ্ছে

পাচার করা অর্থ আপস রফায় ফেরত আনার বিধান হচ্ছে

প্রতীকী ছবি

 বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:০৩ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০৭:১৫

বিদ্যমান আইনে মানি লন্ডারিং একটি অ-আপসযোগ্য অপরাধ। আপসের ভিত্তিতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার কোনো বিধান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে নেই। এখন আপসরফায় অর্থ ফেরত আনার বিধান হচ্ছে। এ ছাড়া আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত এবং রাষ্ট্রের অনুকূলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার যে বিধান রয়েছে, সেখানেও শিথিলতা আনা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বিশেষ আইনের খসড়া তৈরি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। 

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সভায় এসব অগ্রগতি জানানো হয়। সভাসূত্রে যা জানা গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার এবং ১০ শিল্প গ্রুপের অনিয়ম-জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত বিষয়ে আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা  রয়েছে। ওই বৈঠকে গতকালের সভার বিষয়বস্তু জানানো হবে। অর্থ উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার নীতিনির্ধারকদের বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। 

গতকালের বৈঠকে জানানো হয়, পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে চায় সরকার। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে হবে। দ্রুত কাজ শেষ করতে গিয়ে কোথায় যেন কোনো ফাঁক না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনি সমস্যার বিষয়টি উঠে এলে তা দ্রুত সমাধানের দিকে যাচ্ছে বলে জানানো হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রধান করে টাস্কফোর্স পুনর্গঠনের পর গতকাল ছিল প্রথম সভা। 

বৈঠকে বলা হয়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা দ্রুত দূর করার বিষয়টি বিদেশি আইনি পরামর্শকদের দিক থেকেও বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় এখনও তাদের দিক থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে বিশেষ আইন প্রণয়নে দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। 

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপের অর্থ পাচার, অনিয়ম-জালিয়াতি তদন্তে ১১টি যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সমন্বয়ে এসব দল কাজ করছে। এসব দলের কাজ সমন্বয় করছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বিশেষ কক্ষে চলছে তদন্তের নথিপত্র প্রস্তুতের কাজ।

শেখ হাসিনা পরিবারের বাইরে ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো হলো– এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, ওরিয়ন, বসুন্ধরা, সিকদার, নাসা, জেমকন, নাবিল ও আরামিট গ্রুপ। এসব গ্রুপের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রুপের প্রধান ব্যক্তির ব্যক্তিগত আর্থিক বিষয়ও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ কারাগারে আছেন। অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এরই মধ্যে এসব গ্রুপের মালিকানায় যুক্তদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে বিএফআইইউ। অবশ্য কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রুপের প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট সচল রয়েছে।

বিশেষ আইনের খসড়ায় যা আছে
আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিশেষ আইনের খসড়া এরই মধ্যে তৈরি রয়েছে। এটি চূড়ান্ত হওয়ার পরই পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেবে সরকার। কমিশনের ভিত্তিতে এসব ল’ ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি বিশেষ আইনে যুক্ত করা হচ্ছে।

জানা গেছে, অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে তিনটি বড় দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত, বিদ্যমান আইনে মানি লন্ডারিং একটি অ-আপসযোগ্য অপরাধ। এর ফলে কোনো পাচারকারী চিহ্নিত হওয়ার পর আপসে দেশে অর্থ আনতে চাইলে সে সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী, দেশের আইনে অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। এর পর বিদেশে আইনি লড়াই শেষ করে অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি নির্ভর করে। এটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং ফেরত আনা অনেক কঠিন। 

বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বিদ্যমান আইনে আদালতের মাধ্যমে এই অপরাধ প্রমাণ করা অনেক সময়সাপেক্ষ। এই বিধানে শিথিলতা এনে অর্থের গতিপথের ভিত্তিতে তা ফেরতের ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যমান আইনে রয়েছে, মানি লন্ডারিং অপরাধ প্রমাণিত হলে ওই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। বিশেষ আইনে এমন বিধান থাকছে, যাতে কোনো ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে অর্থ নিলে ওই ব্যাংক অর্থ ফেরত পাবে। রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে অর্থ নিলে এনবিআরে অর্থ ফেরত দিতে হবে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ নিলে তাকে তা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আইনের খসড়ায় আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সকে বিদেশি ল’ ফার্ম নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা নানাভাবে প্রভাবশালী। তারা যেন কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য ব্যাপক পর্যালোচনার ভিত্তিতে বিশেষ আইন করা হচ্ছে। আজ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

১৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার ও ৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ
বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সভায় অর্থ পাচার বিষয়ে এখন পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার একটি বিবরণ তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে গত সরকারের সময় আর্থিক অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করেছেন আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তাদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। আর ৮৪ জনকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সরকারি তদন্ত সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে।

পাচার অর্থ ফেরত আনতে আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স ছিল। সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪ জন। তবে এই টাস্কফোর্স সক্রিয় ছিল না। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রধান করে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়েছে। সদস্য কমিয়ে সভাপতিসহ ৯ জন করা হয়েছে। পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একজন করে প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রয়েছে। আর সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে বিএফআইইউ। গতকালের সভায় এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন

×