বাজেট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব অব্যাহত রয়েছে

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫ | ০১:২৩ | আপডেট: ২০ মে ২০২৫ | ০৮:৩৮
বিগত সরকারের মতো একই ধারায় জাতীয় বাজেট দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেট ব্যবস্থায় কাঠামোগত দুর্বলতা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা যাচ্ছে। সরকার কী ধরনের বাজেট করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে জনগণ বা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেনি বা মতামত নেয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও আমলাতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংকট দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
জাতীয় বাজেট সামনে রেখে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৫-২৬: নীতি সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক বহুপক্ষীয় অংশীজনের বৈঠকে অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের আলোচনায় এমন মত উঠে এসেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গবেষণা সংস্থা সিপিডির সহযোগিতায় এ আলোচনার আয়োজন করে, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে বৈঠকে বক্তারা অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও প্রত্যাশা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর যে ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তার প্রতিফলন সরকারের কার্যক্রমে নেই। বেকারত্বের তীব্র সমস্যা থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের অর্থনীতি পরীক্ষার ধাপ থেকে শিক্ষার ধাপে উন্নীত হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো আছে। সামনে কিছু অনিশ্চয়তা আছে। তবে আমরা সেগুলো বুঝে কাজ করছি।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট পুরোনো ধারাতেই তৈরি হয়, তাহলে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা পূরণ হবে না। তিনি বর্তমান সরকারকে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন ও দায়হীন আখ্যা দিয়ে বলেন, এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও গভীর হচ্ছে। যার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে।
তিনি বলেন, অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো অর্থনীতি এগোতে পারে না। সবাই একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে। নির্বাচন না হওয়ায় আমলাতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যারা ভুয়া জিডিপির তথ্য বানিয়েছিল, তারা এখনও পদে বসে আছে। সরকার কিছু ‘কসমেটিকস’ পরিবর্তন করেছে। প্রকৃত পরিবর্তন হয়নি।
সংস্কারের জন্য নির্বাচন আটকে রাখা ঠিক নয়– মন্তব্য করে আমীর খসরু বলেন, ‘এ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছি, ভবিষ্যতেও দেব। রাজনৈতিক দলগুলো সবাই অভিমত দিয়েছে। কোথায় কোথায় ঐকমত্য হলো, সেগুলো প্রকাশ করছে না সরকার। এতে সময় লাগার কথা নয়। যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি, জোর করলেও হবে না। রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধান হবে রাজনৈতিকভাবে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার কী পরিবর্তন আনছে, কীভাবে দেখাতে পারছে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত করছে– এটাই এখন বড় প্রশ্ন। তিনি বলেন, আগের সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ ত্রিভুজ এখনও অটুট। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দুর্বল হয়ে পড়লে আমলারা আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার না এলে স্থিতিশীল অর্থনীতি সম্ভব নয়।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকারের কার্যক্রমে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্বস্তি না থাকলে অন্য কোনো ক্ষেত্রেই সরকার স্বস্তিতে থাকবে না। বিদ্যমান বৈষম্য প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, শহুরে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের স্বস্তি দিতে ‘ট্রাক সেল’ ৭ শতাংশ বাড়ালেও কাবিখা প্রকল্পে সরকার ৪০ শতাংশ কাটছাঁট করেছে। দরিদ্রদের সহায়তায় বৈষম্য হচ্ছে এই সরকারের সময়ে, যা প্রত্যাশিত নয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে একটা টাস্কফোর্স কাজ করছে। অর্থ উদ্ধারে দরকষাকষির ভালো দক্ষতা লাগবে। তবে আমরা এ নিয়ে যত কম কথা বলব, ততই ভালো হবে। তিনি বর্তমান সরকারের সময়কালের মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর নিষ্পত্তির সুপারিশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, যারা আগের সরকারের বাজেটের সমালোচনা করতেন, তারাই এখন বাজেট করছেন। তাই পরিবর্তনের আশা করা স্বাভাবিক। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল বলেন, বেকারত্ব দেশের বড় সংকট। বিনিয়োগ মন্থর হওয়ায় কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শারমিন্দ নিলোর্মি বলেন, শুধু স্কুল নির্মাণ করলে হবে না; মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকলে মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে না, কর্মসংস্থানও বাড়বে না।
রামরুর চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ লোক বিদেশে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের জন্য পরিকল্পনা নেই। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এনামুল হক বলেন, বাজেটের মূল উদ্দেশ্য জনগণকে সেবা দেওয়া। কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তার নেই, শিক্ষায় মান নেই। ধনী বিদেশে চিকিৎসা নেয়; গরিব পড়ে থাকে রাস্তায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, পিডিবির হাতে নীতি তৈরি, দর নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের একচেটিয়া ক্ষমতার পরিবর্তন দরকার। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ নীতি পক্ষাঘাতগ্রস্ততায় ভুগছে। কৌশল নেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশ থেকে পাচার হওয়া ১৫ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের এক-তৃতীয়াংশ ফিরিয়ে আনলে অর্থনীতিকে অনেক এগিয়ে নেওয়া যেত। বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই হবে।
- বিষয় :
- বাজেট