ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে জমা বেড়ে ২৩ গুণ

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে জমা বেড়ে ২৩ গুণ

কোলাজ

 বিশেষ প্রতিনিধি 

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০১:৩৪ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ | ১৩:৪১

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২৪ সাল শেষে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোর লেনদেন স্থিতির পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান নামে এই তথ্যগুচ্ছের মধ্যে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান রয়েছে। 

২০২৪ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশের নামে পাওনা রয়েছে ৫৯ কোটি ৮২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ফ্রাঁ ১৫০ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ছিল মাত্র ২ কোটি ৬৪ লাখ ফ্রাঁ। এখনকার বিনিময় হার ধরলে যার পরিমাণ ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৩ গুণ। 

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে দায়ের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা, আমনাতকারীদের পাওনা এবং পুঁজিবাজারে বাংলাদেশের নামে বিনিয়োগের অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা। এই অর্থ বাণিজ্যকেন্দ্রিক অর্থ বলে এর আগে বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা ৫৭ কোটি ৬৬ লাখ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে যা ছিল মাত্র ৩৫ লাখ ফ্রাঁ বা প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বেড়েছে ১৬৫ গুণ। ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর পাওনা ছিল মাত্র ১ কোটি ৯৩ লাখ ফ্রাঁ। ২০২২ এবং ২০২৩ সালের তুলনায় এক্ষেত্রে অনেক বড় উল্লম্ফন হয়েছে। গ্রাহকের আমানত এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যা দেখা যায়নি। 

গত বছর শেষে বাংলাদেশের ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহক আমানত রয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ফ্রাঁ, যা প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ বা ২১০ কোটি টাকা। ব্যাংক এবং আমানতকারী গ্রাহক মিলিয়ে গত বছর বাংলাদেশের পাওনা (পুঁজিবাজার বাদে) ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ফ্রাঁ, যা এখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী ৮ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকার সমপরিমাণ। আগের বছর ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ফলে এক্ষেত্রে এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৩৩ গুণ। 

এদিকে সম্পদ ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে বিভিন্ন শেয়ার বা সিকিউরিটিজে ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৬ লাখ ফ্রাঁ বা প্রায় ১৩০ কোটি টাকার সমপরিমাণ। আগের বছর ছিল ৮৭ লাখ ফ্রাঁ। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ যোগ করলে বাংলাদেশের নামে ওই সময় পর্যন্ত জমা থাকা মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯ কোটি ৮১ লাখ ৬৩ হাজার ফ্রাঁ। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৩ গুণ বেশি। 

বাংলাদেশের নামে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ অনেক বাড়ার কারণ জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিসংখ্যান জানানো হয়। তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা নিয়ে জানানোর চেষ্টার কথা জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের দাপ্তরিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি গ্রাহক আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে তাও জানা যায় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোপনীয়তার স্বার্থে সমস্ত ডেটা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করে। আলাদাভাবে কোনো গ্রাহক বা ব্যাংকের তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই। 

কয়েক বছর ধরে সুইজারল্যান্ড বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগও করেছিল। কিন্তু ব্যক্তির তালিকাসংবলিত কোনো তথ্য তারা দেয়নি। সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে কেউ অর্থ নিয়ে গেছে এমন প্রমাণ সরবরাহ করলে তারা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। 

সুইস ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের নামে দায় এক বছরে এত বড় উল্লম্ফন কেন হলো, তা প্রশ্নের অবকাশ রাখে। তবে এই বাড়ার পেছনে অর্থ পাচারের অনুমান করা গেলেও কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন। 

জাহিদ হোসেনের মতে, ব্যাংকগুলোর নামে পাওনা এত বেশি উল্লম্ফনের সঙ্গে বাণিজ্যকে পুরোপুরি মেলানো যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে আসবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমেও অর্থ পাচার এবং মানি লন্ডারিং হয়ে থাকে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। গণঅভুত্থানে আগস্টে সরকারের পতন হয়েছে। ধারণা করা যায়, ওই বছর অর্থ পাচার বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত পরিসংখ্যানগুলো যাচাই করে এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।

২০২২ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যায়। এর আগ পর্যন্ত কয়েক বছর বেড়েছিল। ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রাঁ। ২০২২ সাল শেষে কমে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮৪ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৮৭৬ কোটি টাকা। পরপর দুই বছর কমে যাওয়ার পর ২০২৪ সালে এসে আবার বাড়ল। 

২০১৭ সালে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানান, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা মূলত অর্থ পাচার নয়। তবে সামান্য অর্থ পাচার হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য ছিল– এই হিসাবের বেশির ভাগই আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রিক। 

প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বাণিজ্যের আড়ালে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার প্রাক্কলন করে। জিএফআইর প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে ২০১৩ সালে বিভিন্ন দেশে কোম্পানি খুলেছে এমন ৩২ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত আইসিআইজের পানামা পেপারস ডেটাবেজে ৫৬ জন বাংলাদেশির নাম ছিল, যারা করের স্বর্গ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়েছেন। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারসে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে একই পেপারসের সংযোজনীতে ২২ বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়। কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ গোপন করত, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে; পরিবারের সদস্যদের উন্নত জীবনযাপন ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে এবং অন্যান্য কারণে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি
এদিকে সুইস ব্যাংকে ভারতের থাকা অর্থও আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। ভারতের নামে ২০২৩ সালে ছিল (পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাদে) ১০৩ কোটি ফ্রাঁ। ২০২৪ সালে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কোটি ফ্রাঁ। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে দায় কমেছে। পাকিস্তানের কাছে ২০২৪ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোর দায় ২৭ কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর যা ছিল ২৯ কোটি ফ্রাঁ। এদিকে শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের কাছে সুইস ব্যাংকগুলোর দায় বেড়েছে।

আরও পড়ুন

×