গত ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি মো. ইসমাইল হোসেন একটি হত্যাকাণ্ড, যাকে চট্টগ্রাম গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করা হয় তার রায় ঘোষণা করেছেন ঘটনার ৩২ বছর পর। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। রায়ে আদালত পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে ২৪ জন মানুষ হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

একটু পেছনে ফেরা যাক। এরশাদ তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বেশ ঝাঁকিয়ে বসেছেন। ক্ষমতার মোহ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তাকে সহায়তা করছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ। এরশাদ তার ক্ষমতার রাজনীতি শুরু করেছিলেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে। প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে রাষ্ট্রপতি। ঠিক তার গুরু জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। একসময় হয়ে উঠলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরশাসক। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এগিয়ে এলো এ দেশের ছাত্রসমাজ। গঠিত হলো স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কিছুদিন পর তাদের এই আন্দোলনে যোগ দিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় ঐক্যজোট, শ্রমিকদের সংগঠন স্কপ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শামসুল হকের নেতৃত্বে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। আন্দোলন চলছে; কিন্তু তাতে তেমন গতি আসছে না। এরপর সবার সঙ্গে যোগ দিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ আটদলীয় ঐক্যজোট আর বামপন্থি দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ দলের মোর্চা। গতি এলো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে।

এই দেশে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হয়েছে তার নজির নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পেশাজীবীদের সংগঠন দেশের বড় বড় জেলায় তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করল। চট্টগ্রামেও পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আর চট্টগ্রাম বারের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল। সংগঠনের দায়িত্ব পড়ল আমাদের ওপর। বাবুলরা সারা জীবন দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিনিময়ে কিছু পাননি বা চানওনি। আমাদের সঙ্গে আরও যোগ দিলেন অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন। পেশাজীবীদের অস্থায়ী দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হতো আন্দরকিল্লায় অবস্থিত শিক্ষা ভবনে শিক্ষক সমিতির অফিস।

একসময় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট, বামপন্থিদের পাঁচদলীয় জোট, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোটের ধাক্কায় এরশাদের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। কিছুদিন পর এই আন্দোলনে যোগ দেয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি। বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করে এরশাদবিরোধী জনমত গঠন করতে ব্যস্ত। খবর এলো, আটদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ প্রধান দু'দিনের সফরে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আসবেন। প্রথম দিন তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভায় ভাষণ দেবেন। এর পরদিন তিনি শহরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে সভাপতিত্ব করার কথা আমার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একটি অত্যন্ত গৌরবময় ইতিহাস আছে। জেনারেল জিয়ার আমলে এই শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রথমে রাজপথে মিছিল করেছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে এরশাদ অনির্দিষ্টকালের জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নেবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট এরশাদের সামরিক আইন যখন তুঙ্গে, তখন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতার নামে সিনেটে শোক প্রস্তাব নেয় আর সেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কারণে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ, তখন শিক্ষক সমিতি সিদ্ধান্ত নেয়, শহরের এমইএস কলেজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প ক্যাম্পাস খুলে সেখানে প্রতীকী ক্লাস নেবেন।

২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা লালদীঘি ময়দানে জনসভা করবেন। তা নানাভাবে চট্টগ্রাম শহরে প্রচার করা হয়। আগের দিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ঘোষণা দেয়, লালদীঘির মাঠে কোনো জনসভা করতে দেওয়া হবে না। স্টেজ বানানোর সরঞ্জাম পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। তখন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা। তার একটু পরিচয় প্রয়োজন। ১৯৭১ সালে মির্জা রকিবুল হুদা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর পদমর্যাদার একজন অফিসার। তিনি তখন যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন এবং পুরো ৯ মাস পাকিস্তানের পক্ষে ও মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে তিনি যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তানে ফেরত যান। বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় পরবর্তীকালে তিনি অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে ফেরেন। বঙ্গবন্ধু এরূপ অফিসারদের দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন বটে; তবে কাউকে আর সেনাবাহিনীতে ফেরত নেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়া এই অফিসারদের মধ্য থেকে ১৪ জনকে পুলিশ বাহিনীতে আত্তীকরণ করেন, যার মধ্যে মির্জা রকিবুল হুদা অন্যতম। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এলে মির্জা রকিবুল হুদাকে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি হিসেবে পদোন্নতি দেন। ২১ জানুয়ারি যারা দণ্ডিত হয়েছেন, মির্জা রকিবুল হুদাও তাদের অন্যতম। বর্তমানে তিনি প্রয়াত।

পুলিশের আদেশ জারির কারণে ঠিক হয়, শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী জেলা পরিষদ মার্কেটের বারান্দা থেকে তার বক্তব্য পেশ করবেন। সকাল ১১টা নাগাদ তাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানটি চট্টগ্রাম পৌঁছে। তাকে চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা একটি খোলা ট্রাকে তোলেন। বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম শহরের দূরত্ব আনুমানিক দশ কিলোমিটার বা তারও কম। পথে পথে তিনি একাধিক পথসভায় বক্তৃতা দেন। দুপুর ২টা নাগাদ তিনি লালদীঘির দুইশ' গজ দূরে কোতোয়ালি থানার মোড়ে পৌঁছান। চারদিকে তখন নেতাকর্মীদের এরশাদবিরোধী স্লোগান। হঠাৎ কোনো উস্কানি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা শেখ হাসিনার ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়তে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই, শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আমরা যারা অদূরে দণ্ডায়মান, তারা পুলিশের ছোড়া গুলি আর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার কারণে পিছু হটি। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য নেতাকর্মীরা তার চারপাশে মানব প্রাচীর তৈরি করেন। ট্রাকে অবস্থানরত আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি নিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে আদালত পাহাড়ে ওঠে পড়েন। তখন চারদিকে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য মানুষ কাতরাচ্ছে। অনেক লাশ পাশের বড় ড্রেন ও রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কর্মীরা তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাতে পুলিশ ২৪টি লাশ হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায়, যার মধ্যে সব ধর্মের মানুষই ছিল। সেই রাতেই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব লাশকে অভয় মিত্র শ্মশানঘাটে পুড়িয়ে ফেলা হয়। একটু সন্ধ্যা হলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সার্সন রোডের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। শহরে নেমে আসে এক ধরনের কবরের নিস্তব্ধতা, যেমনটি কারফিউর সময় দেখা যায়। পেশাজীবীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতবিনিময়ের অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে হয়। কারণ পুরো এলাকা পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল।

আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসা আর আমার বাসা একই পাড়ায়। সকাল ৮টার দিকে তার বাসভবনে গেলে দেখি, সেখানে শ'খানেক নেতাকর্মীর জমায়েত। ভেতরে গিয়ে দেখি, শেখ হাসিনা তখনও ওপর থেকে নামেননি। একটি সোফায় গিয়ে বসার কিছু পরে তিনি নিচে নেমে ঠিক আমার পাশের সোফায় বসে সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করেন, 'এখন আমি কী করব?' তাকে বলি, এখন তার চট্টগ্রামে থাকাটা নিরাপদ নয়; তিনি যেন ঢাকা ফিরে যান। একটু পরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এসে জানালেন, তিনি নেত্রীর ঢাকা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বারবার বলছিলেন, 'এতগুলো মানুষ আমার জন্য প্রাণ দিল।'

এই ঘটনা তদন্ত করার জন্য চট্টগ্রাম বারের সভাপতি জালালউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি গণতদন্ত কমিটি হয়েছিল। তার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম আমি। প্রায় দেড় মাস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি, আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য শুনে একটি রিপোর্ট আমরা প্রকাশ করেছিলাম ও বলেছিলাম, এই ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায় চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসনের। তা পরদিন সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এরশাদের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য একবার আমাকে জানিয়েছিলেন, এরশাদ এই রিপোর্টে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে মন্ত্রিসভার এক সভায় স্কাউন্ড্রেল বলে গালি দিয়েছিলেন। এর অনেক দিন পরে তার সঙ্গে আমার ঢাকা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দেখা। তখন তিনি সংসদ সদস্য। তার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে যখন এই বিষয়টা তার সামনে উত্থাপন করি, তিনি বলেছিলেন- 'প্রফেসর সাহেব ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়। ক্ষমা করে দিয়েন।' ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করার প্রথম বড় ধরনের চেষ্টা। তারপর ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা।

১৯৮৮ সালে সংঘটিত এ ঘটনার রায় হলো ৩২ বছর পর। আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় হলো ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচারের এত দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক ঘটনা বিচারহীন থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে ১৭ জন নিহত হয় আর এতে ২৪ জন। আমাদের বিচারব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণেই বিচার পেতে দেরি হয়। এটা মোটেও কাম্য নয়। এর ফলে কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয় জোরালো পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বিশ্নেষক ও গবেষক