স্থির জলাশয়। কেউ ঢিল ছুড়লেন সেই জলে, সঙ্গে সঙ্গে জলের স্তর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সব আবার আগের মতো হয়ে গেল। অর্থাৎ ঢিল মারা জলে যে চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা খানিকটা সময় পর আবার স্থির হয়ে গেল। এটাই কিন্তু বাস্তব এবং এই বাস্তবতার সঙ্গে সমাজেরও অনেক ক্ষেত্রেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়- এও সত্য।

প্রতিবারের মতো এবারও পালিত হলো পুলিশ সপ্তাহ। পুলিশ সদস্যদের প্রশংসা করে সরকারপ্রধান বক্তব্য দিয়েছেন, আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশকে আরও জনবান্ধব হওয়ার জন্য। ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সরকারি বাসভবনে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে পুলিশের কর্মকর্তারা সুদমুক্ত বাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদায়নের প্রশ্ন তুলেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হ্যাঁ-সূচক জবাবও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, 'এটা কিন্তু আপনারা চাননি, আমি নিজে থেকেই বললাম।' আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৈনন্দিন কাজ নয়, 'পুলিশ সপ্তাহ' যখন চলছিল, ঠিক তখনই রাজধানী ঢাকায় দু'দুটি ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনা দুটি দু'রকম উদ্বেগের; কিন্তু বিষয় একই। বিষয়টি হলো জননিরাপত্তার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ অফিসাররা সবাই ধরাবাঁধা বাক্যে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন খবরের কাগজে। পড়ে প্রীত হয়েছি; কিন্তু স্বস্তি তো পাইনি! এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কি স্বস্তির অধিকার নেই? নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারব না? শুধুই প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যে, আমাদের ভবিষ্যৎ কোন পথে চলছে? প্রশ্ন জাগে, চলছে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়? রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা এসব ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলেন বটে; কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, আবার সব চাপা পড়ে যায় এবং অপরাধ ঘটে। ক্ষোভ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কোনোটাই যেন আমরা দৃঢ় অবস্থান নিয়ে করতে পারছি না। অনেকের মতো আমারও মনে হয়, সে কারণেই সমাজে জঙ্গিবাদ, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী তৎপরতা ও সাম্প্রদায়িক অপকর্মের ঘটনা ঘটে চলেছে।

সচেতন-প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা একজন ডা. সারওয়ার আলী। তিনি ছাত্রজীবন থেকে আদর্শিক রাজনীতির হাল ধরেছিলেন। সময়ের বিবর্তনে মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিতেও তাঁর অবদান একইভাবে পরিস্টম্ফুট। তিনি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একজন লড়াকু যোদ্ধা। সম্প্রতি সেই ডা. সারওয়ার আলীকে উত্তরায় তাঁর বাসভবনে ঢুকে তৃতীয়তলায় মেয়ের পরিবারকে জিম্মি করে চতুর্থতলায় তাঁকেই হত্যা করার জন্য দুর্বৃত্তরা ঢুকেছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনা অনেক বার্তাই দিয়ে গেল। এই দুর্বৃত্তদের জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা উঠেছিল। তা না হলে অমায়িক ব্যবহারের মিষ্টভাষী মানুষ ডা. সারওয়ার আলীকে কেন হত্যার অপচেষ্টা করা হবে এবং কারাই-বা করবে! সারওয়ার আলীর মতো একজন উদার মনোভাবসম্পন্ন, সজাগ ও সক্রিয় ব্যক্তির বাসায় ঢুকে এমন আক্রমণে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, জঙ্গি সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম মোটেই গুটিয়ে যায়নি; বরং গোপনে গোপনে তারা সক্রিয় এখনও। জঙ্গি-সন্ত্রাসী কিংবা যে কোনো ধরনের অপরাধী মানবতা-সভ্যতার শত্রু। ওদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, তারাও সমকাতারেরই। তাই আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিচার প্রত্যাশার ক্ষেত্রে উভয়েই রয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি গণমানুষের অনুভূতি অনুধাবন করুক।

আর একটি ঘটনা ঘটেছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায় অজ্ঞাতপরিচয় দুর্বৃত্ত। জ্ঞানহারা মেয়েটি জ্ঞান ফিরে পেলে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। তারপর তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। ওই বর্বরোচিত ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষায়তনে ও সমাজে ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়। শেষ পর্যন্ত র‌্যাব ধর্ষককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে ঢাকার শ্যাওড়া এলাকা থেকে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে জানলাম, ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডটি ক্রাইমজোন। এ রকম ক্রাইমজোন ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও আছে, তাতে সন্দেহ নেই। যদিও মেয়েটির সল্ফ্ভ্রম ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না; তবু যদি দৃষ্টান্তযোগ্য বিচার নিশ্চিত হয়, তাহলে সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষালয় ও সমাজে যখন প্রতিবাদে মানুষ সোচ্চার, তখনই ধামরাইয়ে বাসে একটি সিরামিক কারখানার কর্মীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণোত্তর হত্যা করা হয়। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাসে ধর্ষণ ও ধর্ষণোত্তর হত্যাকাণ্ডের শিকার বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী রুপার কথা। রুপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় মাত্র ১৪ কার্যদিবসে সম্পন্ন হয়েছিল এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ দণ্ডও মানুষরূপী নরপিশাচদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। এ জন্য দ্রুত বিচারের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ ও মূল্যবোধ পুষ্ট করায় আরও জোরদার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রায় নিত্য সংবাদমাধ্যমে ধর্ষণের খবর প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছে, যেখানে চার বছরের শিশুও এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার চিত্র ফুটে উঠছে। এই ব্যাধির নিরসন ঘটাতে হবে যূথবদ্ধ প্রয়াসে।

কুমিল্লায় ধর্ষণের পর তনু নামের যে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছিল, এর কোনো কূলকিনারা আজও হলো না। তবে ঢাবির ওই শিক্ষার্থীটি যে দৃঢ়তা ও সাহস দেখিয়েছেন, তা অন্যদের প্রতিবাদী হতে সাহস জোগাবে। রাষ্ট্রশক্তিকে অনুরোধ করব, ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান করুন। না হলে দেশটা উচ্ছন্নে যাবে। বেপরোয়া ধর্ষণ যাতে বন্ধ হয়, তার চেষ্টা করুন কায়মনোবাক্যে। রাষ্ট্র যদি রাজনীতিবিহীন হয়ে যায়, তাহলে সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ নানা অপকর্মের হোতারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এই সামাজিক অপরাধ-অনাচার-দুর্বৃত্তায়ন, নানা অগ্রহণযোগ্য তৎপরতা রোধ করাই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য হওয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্যই 'গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা' হবেন, এটা আশা করি না। বিশাল বাহিনীর মধ্যে নানা কিছিমের মানুষ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো গোটা বাহিনীকে বাংলার গর্ব-গৌরব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। দেশে এত ধর্ষণ আর দুর্নীতির কাহিনি শোনা যাচ্ছে কিংবা জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না। দেশ পরিচালকরা ভেবে দেখবেন, এই যে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম এগুলো পরস্পর ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে; কিন্তু নিরাপত্তাহীনতাই প্রধান বিষয়। মানুষের জীবনযাত্রা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা যেমন একটি প্রধান বিষয়, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ-স্বচ্ছ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।

আমরা আশা করি, রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে। ধামরাইয়ে বাসে ধর্ষণ ও ধর্ষণোত্তর হত্যার ঘটনারও দ্রুত বিচার হবে। ধর্ষকের দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত হবে। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রশক্তি সক্ষমতার পরিচয় দেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীটির ঘটনায় বিচারের জন্য সব মহল যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনায় তেমনটিই চাই। ডা. সারওয়ার আলী আক্রান্ত হওয়ার ঘটনারও উৎসে যেতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ কিংবা অপরাধীচক্রের মূলোৎপাটনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির নিরসন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই জরুরি। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রের। আমরা সে ক্ষেত্রে

রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেখতে চাই না।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব