কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গি গোষ্ঠীর আটক হওয়া সদস্যদের সঙ্গে রোববার আটকদের পার্থক্য রয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা রাজধানীর একটি ইসকন মন্দিরে হামলা করতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশে হলি আর্টিসান হামলার পর থেকে সরকার, প্রশাসন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতায় বড় ধরনের কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া বলা যায়, এখন বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনগুলোও অতীতের তুলনায় কম সক্রিয়। ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, মধ্য আফ্রিকা ও সিরিয়া-লিবিয়ার কিছু অংশে এখনও আইএস, আল কায়দা, আল শাবাব বা বোকোহারাম নামে কিছু জঙ্গিগোষ্ঠী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের মূল ঘাঁটি পতনের পর জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা আগের তুলনায় কমছে। বিভিন্ন দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো নানাভাবে তাদের সদস্য নিয়োগ দিয়ে থাকে। আমাদের ধর্মীয়, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে এ দেশে গত তিন যুগে অনেক জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠতে দেখা গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই হলি আর্টিসানে হামলার ঘটনা ঘটে। তারপর কেবল প্রশাসনই তৎপর হয়নি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একধরনের সামাজিক সচেতনতাও তৈরি হয়। এ প্রচেষ্টায় সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এতদ্‌সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করছি, প্রায়ই বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার হচ্ছে। দেশে জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিশেষ টিম কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। যার ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের ভিত শক্তিশালী করতে পারছে না।
বাংলাদেশে বিশেষত আমরা দুটি জঙ্গি সংগঠনের নাম বেশি শুনে থাকি। একটি নব্য জেএমবি, যারা ইসলামিক স্টেট তথা আইএসের আদর্শে দীক্ষিত। আরেকটি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। যার পূর্বের নাম ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। নব্য জেএমবির প্রাথমিক টার্গেট ছিল বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি সংগঠন ও বিদেশি নাগরিকের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা। আক্রমণের মধ্য দিয়ে দেশে অরাজকতা তৈরি করা। এর মাধ্যমে হয়তো তাদের ভাবনা, ইসলামী খেলাফত তৈরি সহজ হবে।
অপরদিকে, আনসার আল ইসলামের টার্গেট প্রথম থেকেই সেই সব ব্যক্তি, যারা তাদের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য বিষয়ে লিখে বা কথা বলে, তাদের হত্যা করা তারা 'সঠিক' মনে করে। তাদের আক্রমণের প্রথম শিকার ব্লগার রাজীব। এরপর তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকের ওপর আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের রূপ ছিল চাপাতি দিয়ে হামলা। ইউএসএইডের কর্মকর্তা সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটার কর্মী মাহবুব তনয়সহ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এ সংগঠনটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে সক্ষম হয়। তবে কয়েক বছর ধরে তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম আমরা দেখতে পাইনি। এ দুটি সংগঠনের বাইরে 'আল্লার দল' নামে একটি সংগঠনের খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়। যদিও তাদের কর্মতৎপরতার বিশদ আমরা জানি না।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যকে রোববার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গ্রেপ্তার করে। তারা রাজধানীতে ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করেছিল। এ জন্য ঢাকায় হামলাকারী গ্রুপটি মিলিত হয়ে গোপন বৈঠকও করে। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিগ্রাম, অনলাইন চ্যাট গ্রুপ ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে। একই সঙ্গে অনলাইনে অর্থও সংগ্রহ করে। এর মধ্যে একজন চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করে। আরেকজন মালয়েশিয়াফেরত। অন্যজন জাহাজ ভাঙা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ থেকে সদ্য অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করাও যুবকও তাদের মধ্যে ছিল।
ইসকনকে টার্গেট নতুন নয়। গত নভেম্বরেও ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এমনকি ২০১৬ সালেও সাতক্ষীরায় ইসকন মন্দিরের সেবায়েতের ওপর হামলা করা হয়, যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। 'ইসকন' হলো ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। এটি বিশ্বজুড়ে বৈষ্ণব মতবাদের অনুসারী হিন্দু ধর্মের একটি সংগঠন। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইসকনের মূল ধর্মবিশ্বাসটি শ্রীমদ্ভাগবত ও ভগবদ্গীতা গ্রন্থদ্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসকনের সদস্য কিংবা এ সংগঠনের ভাবাদর্শের অনুসারী। প্রতিষ্ঠিত ধর্ম তথা ইসলাম, খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ইসকনকে অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। যদিও বিশ্বজুড়ে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে ইসকন সদস্যরা এক ধরনের নিভৃত জীবনযাপন করে থাকেন।
মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে ইসকনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বিভিন্ন ইসলামী বক্তা তাদের জলসায় অভিযোগ করেছেন, ইসকন বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ইসকনের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড, যেমন- শিশুদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বস্ত্র বিতরণ বা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত মেডিকেল ক্যাম্প ইত্যাদি কর্মসূচিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকিস্বরূপ বর্ণনা করেন তারা। ওয়াজ মাহফিলে এ ধরনের উক্তি হয়তো আনসার আল ইসলামকে ইসকনের বিরুদ্ধে আক্রমণে উৎসাহিত করতে পারে। যেহেতু ইসকনের বিভিন্ন কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের আনাগোনা আছে, এগুলোতে কোনো ধরনের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তাই আমি আশা করব, একদিকে প্রশাসন তথা নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী সব উগ্রবাদী সংগঠনের ওপর নজরদারি চালিয়ে যাবে; একই সঙ্গে ইসকনসহ সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের ওপর কড়া নজর রাখবে। একই সঙ্গে এটাও আশা করা সঙ্গত হবে, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ইসকনসহ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে না। ভারতে ধর্মীয় উত্তেজনা নিয়ে এমনিতেই উপমহাদেশে অস্থিরতা চলছে। বাংলাদেশে ইসকনে হামলার মতো ঘটনা তাতে ঘৃতাহুতি দিতে পারে।
আমরা প্রায়ই বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যের গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ পাই। কিন্তু তদন্ত শেষে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা বা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্নের সংবাদ পাই না। এমনকি দেখা যায়, তদন্ত কার্যে দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ফলে তারা বেরিয়ে আসে। আমরা চাইব না কোনো নির্দোষ ব্যক্তি নির্যাতনের সম্মুখীন হোক। আমরা চাইব, যারা সত্যিকার অর্থে কোনো ধরনের উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার হয়ে যেন যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। একই সঙ্গে যুব সমাজের মধ্যে যে উগ্রবাদবিরোধী প্রচার চলছে, তা আরও জোরদার করা হোক।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক; অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক