- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- বঙ্গবন্ধুর 'কৃষক' রহমত আলী
বঙ্গবন্ধুর 'কৃষক' রহমত আলী

অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী বাংলাদেশের রাজনীতি অঙ্গনে এক পরিচিত নাম। শত জেল-জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতন তাকে কাবু করতে পারেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা রহমত আলী জন্মেছিলেন এক কৃষক পিতার ঘরে। কালের পথপরিক্রমায় জীবন ঘষে যারা আগুন জ্বেলেছেন; রহমত আলী সেই আলোর পথযাত্রী। যার আলোয় আলোকিত একটি জনপদ। মাটি, মানুষ আর সুন্দর জন্মভূমি সোনার বাংলাকে আপন জেনে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একদিন রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। রহমত আলী জীবনের প্রায় পুরোটা অংশই বিনিয়োগ করেছেন এই দেশ আর দেশের মানুষের জন্য। বিনিময়ে তিনি কিছুই চাননি জীবনে। শুধু চেয়েছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। ৭৫ বছর বয়সে রোববার সকালে জীবনের কাছে হার মেনে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। তার মৃত্যুতে রাজনীতির আকাশ থেকে যেন একটি নক্ষত্র খসে পড়ল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের বছর ১৯৪৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী রাজনীতির কিংবদন্তি রহমত আলী গাজীপুরের শ্রীপুর গ্রামে কৃষক বাবা মো. আছর আলীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়সে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তিনি। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রহমত আলীর সরব উপস্থিতি ছিল রাজনীতির মাঠে। এই দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে রহমত আলী অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জীবনের অনেকটা সময়ই চলে গেছে জেলখানায় বন্দি থেকে। বিভিন্ন মেয়াদে তাকে পাঁচবার থাকতে হয়েছে জেলে। কয়েকবার মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ভাগ্যক্রমে এসেছেন ফিরে। তবুও এই লড়াকু রাজনীতিবিদ পিছপা হননি। ব্যর্থতার কোনো গ্লানি ভর করেনি তার জীবনে।
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা, '৬৯-এর গণআন্দোলন, '৭০-এর নির্বাচন, '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রায় সব আন্দোলনেই অগ্রপথিকদের দলে ছিলেন রহমত আলী। গাজীপুরের মানুষ তাকে 'উন্নয়নের রূপকার' উপাধিতে ভূষিত করে থাকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ক রহমত আলী একজন সার্থক পিতাও বটে। তার বড় ছেলে ড. জাহিদ হাসান তাপস খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী। ড. তাপস ভাইল ফার্মিয়ন নামে অধরা কণা আবিস্কার করে পৃথিবীজোড়া হৈচৈ ফেলে দেন।
রহমত আলী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় 'বাংলাদেশ কৃষক লীগ'। প্রতিষ্ঠাতা কমিটির অন্যতম সদস্য করা হয় রহমত আলীকে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে কৃষক লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাদল রশীদকে সভাপতি এবং রহমত আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করা হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত রহমত আলী এই পদে বহাল থাকেন। একই সময় রহমত আলী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। কৃষক নেতা হিসেবে রহমত আলীকে বিভিন্ন দেশের কৃষিভিত্তিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন পর্যবেক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি সফরে পাঠান। বঙ্গবন্ধু 'এই আমার কৃষক' বলে রহমত আলীকে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন- সবসময় কৃষকের পক্ষে কথা বলবে। কৃষকের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। ১৯৮৬ সালে রহমত আলী বাংলাদেশ কৃষক লীগের সম্পাদকের পদ থেকে সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন।
টানা পাঁচবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রহমত আলী। একবার তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও করা হয়। গত নির্বাচনে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রহমত আলী দলের কাছে মনোনয়ন চাননি। প্রয়াত নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
গাজীপুর প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন