কমে গেছে পোস্ট অফিস সেভিংস ব্যাংক বা ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সুদহার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জারি করা পরিপত্রে সঞ্চয় ব্যাংকের সুদহার এক ধাপে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। আগে যেখানে তিন বছরমেয়াদি আমানতের সুদহার ছিল ১১.২৮ শতাংশ, সেখানে তা নামিয়ে আনা হয় ছয় শতাংশে। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙালে এক বছরের জন্য আগে পাওয়া যেত ১০.২০ শতাংশ, এখন মিলবে ৫ শতাংশ। দুই বছরের ক্ষেত্রে তা সাড়ে ৫ শতাংশ, যা আগে ছিল ১০.৭০ শতাংশ। এ ছাড়া সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদহার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার মধ্য দিয়ে চলছে বিশ্ব। সব দেশ বিনিয়োগ বাড়াতে মনোযোগী। এ জন্য সুদহার কমাতে তৎপরতা চলছে। বাংলাদেশেও সরকারের নির্দেশে এই সুদহার কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান। দেশে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্র কম। যাদের সঞ্চয় সীমিত, তাদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ নেই বললে খুব একটা ভুল হবে না।
একটি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সামনে একটি ভাড়া বাসায় ছিল জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়। সে সুবাদেই ১৯৮৫ সালে স্কুলে পড়ার সময়ে পরিচয় ঘটে সঞ্চয় টিকিটের সঙ্গে। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে টিফিনের টাকা, স্কুলে যাতায়াতের রিকশা ভাড়া বা ঈদ-সেলামি জমিয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরের বিভিন্ন মূল্যমানের টিকিট কিনতাম। যতদূর মনে পড়ে, ২৫ টাকার টিকিট জমিয়ে তা কুষ্টিয়া প্রধান ডাকঘরে জমা দিয়ে জীবনে প্রথম হিসাব খুলেছিলাম। বেশ কয়েক বছর চলতে থাকে এই টিকিট জমানোর খেলা। পরে ১৯৯৩ সালে প্রথম হিসাব থেকে টাকা উঠিয়ে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে ৫০০ টাকা দিয়ে তিন বছরমেয়াদি হিসাব খুলি। টিকিট জমানোর সুবাদে এবং এত অল্প বয়সে হিসাব খোলার কারণে কুষ্টিয়া প্রধান ডাকঘরের অনেকেই চিনে ফেলেন। আর ততদিনে ছেলের কীর্তির কথা জেনে যান বাবা। তবে চাকুরে বাবা এ কাজের জন্য আমায় বকা দেননি, উল্টো বছর দুয়েক পর তার জমানো কিছু টাকা আমার হিসাবে রাখেন। কারণ ততদিনে আমার ছোটবেলার সঞ্চয়ের অভ্যাস বদলে গেছে। সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা জীবনে শিখিয়ে দিতে হয়তো বাবা বুঝে-শুনেই কাজটা করেছিলেন। সেই থেকে হিসাবটা রয়ে গেছে এখনও!
নিয়মিত ডাকঘরে যাতায়াতের সুবাদে দেখেছি সাধারণ মানুষ তথা কৃষক, দিনমজুর, রিকশাচালকও ছুটতেন ডাকঘরে। মাস বা কয়েক মাস শেষে জমানো এক-দুইশ' থেকে হাজার টাকা জমা করতেন নিজেদের হিসাবে। এর বড় কারণ, সাধারণের ব্যাংকে যাওয়াটা কখনই অতটা সহজ নয়। তা ছাড়া ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম হওয়াও সমান দায়ী। আজও অনেক টাকার মালিকরা নয়, প্রতিদিন ডাকঘরে ভিড় করেন সাধারণ মানুষ, অবসর নেওয়া চাকরিজীবী আর গৃহিণীরা। এসব মানুষের সামান্য সঞ্চয় বিনিয়োগের সুযোগ কই? যারা জীবনের প্রয়োজনে সঞ্চয় ঝুঁকির মুখে পড়তে দিতে চান না, তারাই যান ডাকঘরে। সামর্থ্যবানরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন। গত এক বছরে নানা বিধিনিষেধে সঞ্চয়পত্র বিক্রির রাশ টেনে ধরা গেছে। এর আগে মাঝেমধ্যে অনেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর কথা বলেছেন। তবে প্রতিবাদ হয়েছে জাতীয় সংসদেও। তবে এবার হয়তো কেউ বলবেন না। কারণ টাকাওয়ালারা ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে টাকা জমান না। সেখানে টাকা জমা রাখেন সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের পক্ষে আর কে বলবেন? তবে সরকারের দায়িত্ব, এসব সাধারণ মানুষের সামান্য সঞ্চয় বিনিয়োগের বিকল্প ব্যবস্থা করা। তাদের সঞ্চয়-স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা। আর তা না করা গেলে সাধারণ মানুষের শুধু সঞ্চয়-স্বপ্নই ভঙ্গ হবে না, তাদের বিপাকও বহুগুণ বেড়ে যাবে। তবে আশার কথা, অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন সুদহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
সাংবাদিক

বিষয় : অন্যদৃষ্টি

মন্তব্য করুন