
আমরা জানি, ১৯৪৮-এর মার্চে, করাচিতে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে ওই সংসদের সদস্য জননেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন তখন খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খান (পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতা ধীরেন দত্তের ন্যায়সঙ্গত সে দাবির বিরোধিতাই শুধু করেননি; বাংলা ভাষা সংক্রান্ত দাবি উত্থাপনের জন্য তাঁকে 'ভারতের দালাল', 'ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমন' প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করতে পরোয়া করেননি। প্রতিবাদে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধিবেশন ত্যাগ করে বিমানযোগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা ঢাকা বিমানবন্দরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সশ্রদ্ধ সংবর্ধনা জানান এবং তাঁকে বীরোচিত মর্যাদায় স্বাগত জানান। সচেতন মানুষমাত্রই এ ইতিহাসও জানেন।
করাচির ঘটনাবলি জানার পর সেদিনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল, বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী তরুণ ছাত্রনেতারা ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করে পূর্ববাংলার সর্বত্র হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের জন্য ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান জানান। এর ফলে প্রদেশের অনেক জেলা যেমন রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ অন্যত্র বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের অংশগ্রহণ উদ্যোগে অত্যন্ত সফল কর্মসূচি পালিত হয়। এ আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। অনেক জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বেশ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হরতাল, মিছিল প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনার বর্ণনা অত্যন্ত সহজ; কিন্তু তৎকালীন বাঙালি মুসলিম মানসের কথা চিন্তায় আনলে, সাম্প্রদায়িকতা ও তার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পটভূমির কথা ভাবলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলা কত কঠিন ছিল!
পাবনা শহরে আহলে হাদিস নামক তৎকালীন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান এক মাওলানার নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে হামলা হয়েছিল। এই একই মহল নাটকের অভিনয়, সংগীত-নৃত্যানুষ্ঠান, আলপনা আঁকাসহ সব সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য বিরোধিতা করত সেগুলোকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে। ভাষা আন্দোলন দমন করার জন্য অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ ও অনেক শিক্ষক-ছাত্রকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা হয়। আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শেখ মুজিবসহ আন্দোলনের বহু নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করতে পূর্ববাংলার কোথাও বিলম্ব করা হয়নি। সংবাদপত্রে সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতেও দেওয়া হয়নি। যত্রতত্র ১৪৪ ধারা জারি করে ভাষা আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সভা-সমিতি, মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। তৎকালীন সমগ্র ইতিহাসের প্রতি চোখ বুলালে, ঘটনাবলি স্মরণে আনলে এই সত্য উদ্ঘাটিত হয়, ধর্মকে ধর্মের জায়গায় এবং রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় পৃথকভাবে স্থান না দিতে পারলে দেশ ও জনগণের সমূহ ক্ষতি হয় এবং এই ক্ষতির মাশুল আজও বাঙালি জাতিকে দিতে হচ্ছে।
ধর্মান্ধ শক্তিগুলো ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করার ফলে স্পষ্টভাবে সবাই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল; ওই শক্তিগুলো শুধু বাংলা ভাষারই শত্রু নয়; বাংলা সাহিত্য, বাংলার শিল্পকলা, বাংলার সংগীত-নৃত্য প্রভৃতিরও চরমতম শত্রু। তাই সেদিন জাতি তাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি। ওইসব অপশক্তি তাদের কর্মকাণ্ডে ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধিতাই শুধু করেনি, আরও অনেক কিছুই করেছিল। বাহান্ন-পরবর্তী বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রাম, গণতন্ত্রের দাবি, যুক্তফ্রন্ট গঠন, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, সম্মিলিত ছাত্রসমাজের ১১ দফা, '৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ১৯৫৪ ও ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তি মোকাবিলায় তারা সক্রিয়ভাবে বিরোধিতাও করেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে ওই অপশক্তিগুলোই তাদের গণবিরোধিতা, বাঙালি-বিরোধিতা নগ্নভাবে প্রকাশ করে বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করার যে অপচেষ্টায় 'পাকিস্তান' ও 'ইসলাম' রক্ষার নামে অবতীর্ণ হয়েছিল, সে ইতিহাস সারাবিশ্বের কাছেই পরিচিত। ভাষা আন্দোলন যে বাঙালির পরবর্তী সব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধানতম উৎস- তা নিয়ে দ্বিমত নেই। দ্বিমত নেই ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ অসম্ভব হতো যদি ভাষা আন্দোলন না হতো। দ্বিজাতিতত্ত্বের উগ্র ধর্মান্ধ চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে যদি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বাঙালির মননে গভীরে স্থান করে নিতে না পারত, তবে পাকিস্তান ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না।
বাঙালি জাতি জীবনমুখী। জীবনকে ভালোবাসে। তাই নিজের ও জাতির জীবনকে রক্ষা করতে সব প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে, সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও মাতৃভাষার মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও আদর্শিক দুশমন জামায়াতে ইসলামী বৈধভাবে এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। সর্বোপরি যখন দেখি, ভাষাসংগ্রামীদের একটি তালিকা পর্যন্ত তৈরি করে তা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করে তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র কিছুতেই এগিয়ে আসে না, তখন একজন ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবতেই হয়- ভাষা আন্দোলন নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক বিপর্যয় প্রতিরোধে কঠোর কার্যকর ভূমিকা ছাড়া বিকল্প নেই। সর্বাগ্রে যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে আদর্শিক বিপর্যয়। আদর্শ বিচ্যুতির নিরসন ঘটাতে না পারলে আমাদের সামনে আরও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
raneshmaitra@gmail.com
মন্তব্য করুন