
করোনাভাইরাসের এখন অফিশিয়াল নাম কভিড-১৯। এই কভিড-১৯ বিদ্যমান বাস্তবতায় এক আতঙ্কের নাম। চীনের উহান শহরে এর উৎপত্তি; কিন্তু ছড়িয়ে গেছে বেশ কয়েকটি দেশে। চীন থেকে সিঙ্গাপুর। জাপান থেকেও এ রকম খবর পাওয়া গেছে। ফ্রান্স থেকেও এসেছে কভিড-১৯-এ মৃত্যুর খবর। কোনো কোনো বিশ্নেষকের লেখায় যে ইঙ্গিতটি রয়েছে তা হচ্ছে, এটা কি শুধুই একটি ভাইরাসজনিত রোগ? এক ধরনের ফ্লু? নাকি এটা এক ধরনের জীবাণু অস্ত্র, যা ল্যাবে তৈরি করা হয়েছে? চীনের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্যই কি এই জীবাণু অস্ত্র চীনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার একটি ল্যাবে এ ধরনের জীবাণু অস্ত্র তৈরি হচ্ছিল- এমন একটি সংবাদ আমরা পাঠ করেছি। আবার এমন কথাও বলা হচ্ছে, উহানে চীনের একটি ল্যাবে এ ধরনের অস্ত্র তৈরি হচ্ছিল। অসাবধানতাবশত তা ল্যাব থেকে 'লিক' হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও কোনো নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
জীবাণু অস্ত্র মানবসভ্যতার জন্য এক ধরনের হুমকি। এই হুমকি পারমাণবিক বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ। জীবাণু অস্ত্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগি প্রবেশ করিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। এটা এতই মারাত্মক যে, এর মাধ্যমে পুরো মানবসভ্যতা ধ্বংস বা বিলুপ্ত করা সম্ভব। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই বিশ্ব ১৯৭২ সালে বায়োলজিক্যাল উয়েপনস কনভেনশন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। ১০৯টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, যা ১৯৭৫ সালের মার্চ থেকে কার্যকর রয়েছে (বর্তমানে ১৮২টি দেশ এই চুক্তিভুক্ত)। যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ১৯৭৫ সালে চুক্তিটি অনুমোদনও করে। চীন অনুমোদন করে ১৯৮৪ সালে আর বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে। তারপরও অনেক অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র গোপনে বিভিন্ন ল্যাবে এই জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে-এই অভিযোগ উঠেছে। চুক্তির ১নং ধারা অনুযায়ী কোনো দেশ যে কোনো অবস্থাতেই হোক না কেন, জীবাণু অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে না। ধারা-২-এ এ ধরনের অস্ত্র ধ্বংস কিংবা ধারা-৩-এ অস্ত্রের ট্রান্সফার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ ধরনের অস্ত্র উৎপাদন, গবেষণা, ট্রান্সফার যখন নিষিদ্ধ, তখন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে এ ধরনের অস্ত্র উৎপাদনে নিজেকে নিয়োজিত করেছে- এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
অনেকেই হয়তো স্মরণ করতে পারবেন ১৯৭৮-৮১ সালে কিউবার পরিস্থিতির কথা। ওই সময় পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। ফিদেল কাস্ত্রো তখন অভিযোগ করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এটা বায়োলজিক্যাল অ্যাটাক। অর্থাৎ জৈব রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! যদিও ওই অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও একটি তথ্য পাওয়া গেছে এবং তা হলো- পৃথিবীর ২৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব রাসায়নিক ল্যাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি এসব ল্যাব পরিচালনা ও গবেষণার জন্য ২.১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। মূলত চারটি দেশ বা অঞ্চলকে (চীন, রাশিয়া, ইরান ও মধ্য আফ্রিকা তথা পশ্চিম আফ্রিকা) কেন্দ্র করেই এসব জৈব রাসায়নিক ল্যাবে গবেষণা হয়। ওইসব ল্যাবে কী ধরনের গবেষণা হয়, তা অনেকেই জানে না। যুক্তরাষ্ট্র কখনও তা স্বীকারও করেনি। সুতরাং হঠাৎ করেই চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং এর কারণে এ যাবৎ দুই হাজার মানুষের মৃত্যু; সেই সঙ্গে চীনের অর্থনীতিতে ধস নেমে আসা-সব মিলিয়ে সেই 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব'কেই সামনে নিয়ে আসে! জানি না, এর প্রকৃত কারণ আমরা আদৌ কোনোদিন জানতে পারব কিনা? কিংবা চীন নিজে তা স্বীকার করে বিশ্ববাসীর কাছে তার অযোগ্যতার কথা জানান দিতে চাইবে কিনা, তাও নিশ্চিত নই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, উহানের করোনাভাইরাসের ঘটনা চীনের রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনবে। আর সেই পরিবর্তনটা যে কী এবং তার প্রভাব কোন পর্যায়ে যায়, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এ কথাটা বলা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র যে জৈব অস্ত্র তৈরি করছে বা গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে, কোনো কোনো গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র তা কখনও স্বীকার করেনি কিংবা অস্বীকারও করেনি। তবে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, পেন্টাগন বিভিন্ন মার্কিন কোম্পানিকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জৈব অস্ত্র তৈরি করতে। এ ধরনের একটি কোম্পানির নাম সিএইচটুএম হিল। এই কোম্পানি পেন্টাগন থেকে সহায়তা পেয়েছে ৩৪১.৫ মিলিয়ন ডলারের। এদের ল্যাব রয়েছে জর্জিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। অনুদানের প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক (১৬১.১ মিলিয়ন ডলার) ব্যয় করা হয়েছে তিবলিসের (জর্জিয়া) লুগার সেন্টারে। আরেক কোম্পানি বেটেলের কথাও বলা যায়। এরা মূলত বিভিন্ন জৈব রসায়ন ও বিষ ইত্যাদি নিয়ে পেন্টাগন নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত যেসব ল্যাব রয়েছে (আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া), সেখানে গবেষণা করে। ২ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তাও তারা পেয়েছে ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে।
অনেকেই জানেন না যে, পোকামাকড়ের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস ছড়ানোর একটি পরিকল্পনাও পেন্টাগন প্রণয়ন করেছিল। এই পরিকল্পনাটি ছিল ইউএস এনটমলিজিক্যাল ওয়ারের একটি অংশ। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মির একটি রিপোর্ট যা পরে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল, ওই রিপোর্ট থেকে এই তথ্যটি জানা যায়। ওই রিপোর্টেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ. অ্যালগিপ্টি নামক এক জাতীয় মশার মাধ্যমে 'ইয়েলো ফিভার' ছড়ানো হয়েছিল। অপারেশন বিগ বাজ-এর আওতায় ১০ লাখ এ. অ্যালগিপ্টি মশা উৎপাদন করা হয়েছিল, যার তিনভাগের এক ভাগ গোলা-বারুদে ভর্তি করে বিমান থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল (যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া, ১৯৯৫)। 'ইয়েলো ফিভার' ছড়িয়ে দিতে এই পরীক্ষা সফল হয়েছিল। তিবলিসে পেন্টাগনের একটি প্রোগ্রাম আছে, যার নাম বায়োলজিক্যাল ওয়েপনস শেয়ারিং প্রোগ্রাম থ্রেট রিডাকশন। এই কর্মসূচির আওতায় জৈব অস্ত্র কীভাবে কাজ করে, তা দেখা হয়। ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়াতে একটি রোগের প্রার্দুভাব ঘটে, যার নামকরণ করা হয়েছিল ক্রাইমিয়ান হেমোগ্রাফিক ফিভার। এরই পরিবর্তিত নাম কঙ্গো ক্রাইমিয়ান হেমোগ্রাফিক ফিভার (সিসিএইচএফ)। এই রোগের জন্য নাইরোভাইরাসকে দায়ী করা হয়। ক্রিমিয়ার পরেই এই রোগের প্রার্দুভাব ঘটেছিল আফ্রিকার কঙ্গোতে। যে কারণে ক্রিমিয়ার সঙ্গে কঙ্গো নামটি যুক্ত হয়েছিল।
অভিযোগ আছে- ল্যাবে মশা-মাছি বা পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে কীভাবে রোগ-ব্যাধি ছড়ানো যায়, তা নিয়ে ওইসব ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। শত্রুপক্ষকে টার্গেট করেই এসব জৈব অস্ত্র নিয়ে গবেষণা ও তা তৈরি করা হয়। যদিও ওইসব জৈব অস্ত্র কোথায় কোথায় ব্যবহার হয়েছে, তার পূর্ণ তথ্য আমাদের কাছে নেই। কিন্তু আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তা হচ্ছে, আফগানিস্তানে ২০১৯ সালে সিসিএইচএফ রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল। হেরাত ও কাবুলে এই রোগের কারণে ৩৫৯ জনের মৃত্যুর খবরও তখন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। শঙ্কার জায়গাটা হলো এই যে, যেসব এলাকায় এই রোগটি (সিসিএইচএফ) ছড়িয়ে পড়েছিল, ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ল্যাব পরিচালনা করে। এখন ল্যাব থেকে ওই রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল কিনা কিংবা হেরাত-কাবুলের মানুষের ওপর তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা, তা আর জানা যায়নি। লুগার সেন্টারে বাদুড় নিয়েও গবেষণা হয়েছিল। বাদুড় ইবোলা কিংবা মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোমের (এমইআরএস)-মতো মারাত্মক সব রোগের জীবাণু বহন করতে পারে, এটা এখন গবেষণাগারে পরীক্ষিত। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এমইআরএস রোগে আক্রান্ত (১৯ দেশে) ১৯৮০ জন রোগীর মধ্যে ৬৯৯ জনের মৃত্যুর খবর রিপোর্ট হয়েছে। এমইআরএস একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে উৎপন্ন হয়েছিল। র্যাবিট ফিভার সম্পর্কে আমরা কতটুকু অবগত? এই র্যাবিট ফিভারের জীবাণুও মার্কিন ল্যাবে তৈরি।
আমরা হয়তো এটা অনেকেই জানি যে, ইউক্রেনে ২০১৪ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে মস্কো সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোবিচ উৎখাত হয়েছিলেন। তার ওই উৎখাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন ছিল। অভিযোগ আছে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু ল্যাব পরিচালনা করে, যার ওপর ইউক্রেনের সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। ফলে সেখানে কী ধরনের গবেষণা হয় এবং তা কোথায় প্রয়োগ করা হয়, তা কেউ জানে না। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশ রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বেশ কয়েক বছর ধরেই। যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। কিন্তু রাশিয়ার রয়েছে তাতে আপত্তি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ল্যাবে উৎপন্ন জীবাণু অস্ত্র ভবিষ্যতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহূত হতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মধ্যে। ফলে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে একটা বড় ভয় রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে জীবাণু অস্ত্রের নানা ধরন নিয়ে গবেষণা হয়- এ তথ্য অনেক পুরোনো। চীনেও এটা নিয়ে গবেষণা হয়- এমন কথাও বলা হচ্ছে কোনো কোনো মহল থেকে। এখন করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় জীবাণু অস্ত্রের বিষয়টি সামনে চলে এলো। এর ভয়াবহতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা ঘোষণার কথা বলেছে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা কিংবা যুক্তরাষ্ট্র আদৌ জড়িত কিনা, আমরা তা স্পষ্ট করে বলতে পারব না। তবে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ল্যাবে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা হয়, সে ক্ষেত্রে এই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্নিষ্টতা অস্বীকার করা যাবে না। আবার জীবাণু অস্ত্র নিয়ে চীনের গবেষণা ও গবেষণাগার থেকে জীবাণু 'লিক' হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকেও হালকাভাবে দেখা যাবে না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রায় সবাই চৈনিক তথা এশীয় বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ চীনা তথা এশিয়ান নাগরিকরাই এই ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত। কেন? জবাবটা হচ্ছে, যে ভাইরাসের মাধ্যমে রোগটি ছড়ানো হয়েছে, তা একটি জৈব মারণাস্ত্র। পরীক্ষাগারে এমনভাবে এই ভাইরাসটি তৈরি করা হয়েছে, যাতে শুধু এশিয়ার মানুষকে তা আক্রমণ করতে পারে। যে কারণে এটাকে বলা হচ্ছে 'জাতিগত বায়ো উইপন'। করোনাভাইরাস বিশ্বে এই মুহূর্তে বড় আতঙ্ক সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে জীবাণু অস্ত্রের বিষয়টিও সামনে চলে এলো। এই জীবাণু অস্ত্র উৎপাদন ও পরীক্ষা যদি পরিপূর্ণভাবে বন্ধ করা না যায়, তাহলে সভ্যতার জন্য তা বড় সংকট বয়ে আনবে আগামীতে।
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
মন্তব্য করুন