ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড থেকে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক তৈরি করতে সম্প্রতি ১৮টি পাহাড় কর্তন করা হয়েছে নির্মমভাবে। জনস্বার্থে কাজটি করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। জনস্বার্থে শর্তসাপেক্ষে এ পাহাড় কাটায় অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দীর্ঘ সময় ধরে এ পাহাড় কাটার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। তদারক করার সুযোগ পায়নি পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল। পরিবেশ অধিদপ্তর বলতে চাচ্ছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শর্ত মানেনি। তারা ৯০ ডিগ্রি কোণে পাহাড় কেটেছে। প্রায় ১১ লাখ ঘনফুট মাটির জীবন্ত সবুজ পাহাড় কেটেছে। পাহাড়কে হত্যা করেছে।

চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর গঠনে বালুর পরিমাণ বেশি। মাটির অন্যান্য কণার সঙ্গে বালুর পরিমাণ বেশি। আর তাই ২০০ মিলিমিটার ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত হলেই কাটা, ক্ষত, আহত, আঘাতপ্রাপ্ত পাহাড়গুলো দ্রুত ধসে পড়ে। এই বিষয়টি এ অঞ্চলের দিনমজুর থেকে শুরু করে সবাই জানে। পাহাড়ের এই ধস চরিত্রকেই পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুরা কাজে লাগায় বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন সময়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরের শর্তের একটি ছিল ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি কোণে পাহাড় কাটতে হবে। যদিও চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো ২০ ডিগ্রি কোণের ওপর কোনোভাবেই কাটা উচিত নয়। সিডিএ এ নির্দেশনাকে পাত্তা না দিয়ে ৯০ ডিগ্রি কোণে ১৫টি পাহাড় কেটেছে। এ কাজটি তাদের ভাষায় করেছে জনস্বার্থে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঠিকাদারি করেছে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স।

দায়িত্বহীনতা এবং নির্লিপ্ততার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। পরিবেশ অধিদপ্তর শর্তসাপেক্ষে নির্দেশনা অনুমোদন দিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে রয়েছে। সিডিএ ঠিকাদারকে দায়িত্ব দিয়ে গা ছাড়া কাজটি করে ফেলেছে। ঠিকাদার মনের মতো পাহাড় কেটে পাশের লেক ভরাট করেছে। মাটি নিয়ে ব্যবসা করেছে। সিডিএ জানে না, এই মাটি দিয়ে লেক ভরাট করা হয়েছে। সব কার্যক্রমই পরিবেশের প্রতি আমাদের কঠিন নির্লিপ্ততা, অবহেলা, দস্যুপনা ও চরম স্বেচ্ছাচারিতা। আমাদের দেশের সবুজ পাহাড়গুলো, নান্দনিক পাহাড়গুলো পরিবেশের অমূল্য সম্পদ। প্রাকৃতিক মূলধন। এর সঙ্গে সাগর, নদী, জলাশয় পরিবেশের নান্দনিকতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার পরিধিকে। আমাদের পরিবেশ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার নির্যাস। এই পরিবেশ, এই সবুজের সঙ্গেই এ দেশের মানুষের হাজার বছরের বসবাস, ওঠাবসা। পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে আমাদের অনেক ঋণ।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিয়ম মেনে পাহাড় না কাটার জন্য অতীতে জরিমানার শিকার হয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল তাদের। দুই বছর না যেতেই সেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আবারও অনিয়মের মাধ্যমে পাহাড় কেটে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এবার তাদের প্রায় ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এভাবে এমন কাটাকাটি এবং জরিমানা কি চলতেই থাকবে? কতদিন এভাবে চলবে? পাহাড় কাটার সময় নির্লিপ্ত থেকে পরবর্তীকালে অপরাধীকে জরিমানা করে পাহাড়কে কতটুকু সুরক্ষিত রাখা যাবে, এ প্রশ্ন অনেকের। ১৮টি পাহাড়ের হত্যাকাণ্ডের মূল্য যদি ১০ কোটি টাকা হয় এবং এই কাটাকাটি ও জরিমানা যদি চলতেই থাকে, তবে সবুজ পাহাড়, পরিবেশ কি সুরক্ষিত থাকবে? ১০ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি পাহাড় কি একই জায়গায় তৈরি করা যাবে? ধারাবাহিক একই অপরাধ সংঘটন করার পর জরিমানা ধার্য বা আদায় করে কি অপরাধকে উৎসাহিত করা নয়?

আমাদের নদীগুলো আদালতের রায়ে অভিভাবকত্ব অর্জন করেছে। জীবন্তসত্তা অধিকার আদায় করেছে। আগামীতে সবুজ পাহাড়গুলোকেও এ পথপরিক্রমা করতে হবে কিনা ভাবনার বিষয়। গত শতাব্দীর শেষার্ধ্ব থেকেই চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কাটাছাঁটা, বিমোচনের আওতায় আসে। তখনকার সময়ের নান্দনিক নামের পাহাড়গুলো আজ তাদের নন্দনতত্ত্ব হারিয়েছে। খুইয়েছে দেহ, সবুজ, গাছ, লতাপাতার সৌন্দর্য। হারিয়েছে ঐতিহ্য। লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের সর্বস্ব। লুণ্ঠনকারীরা পার পেয়ে গেছে। আমরা নির্লিপ্ত থেকেছি। আমাদের নির্লিপ্ততাই তাদের বেপরোয়া হতে সহযোগিতা করেছে। চট্টগ্রামের আকবর শাহ, জঙ্গল সলিমপুর, আরেফিন নগর, জালালাবাদ এলাকা, ষোলশহর, খুলশী, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী এলাকা গত শতাব্দীতে নান্দনিক সবুজ এবং সুষমামণ্ডিত পাহাড় ধারণ করত। ২০২০ সালে এসে এসব অঞ্চলের অনেক পাহাড় সমতল হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, সবুজ হারিয়েছে। এদের দেহ খণ্ডিত-বিখণ্ড হয়েছে। এভাবেই উলিল্গখিত প্রতিটি অঞ্চলের পাহাড়ের প্রায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়েছে। মানবতার পরিধিকে যদি আমরা প্রকৃতি পর্যন্ত বর্ধিত করি, তবে পাহাড় ও সবুজের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতা ইতোমধ্যেই প্রদর্শন করা হয়েছে। পাহাড়ের খাঁজে ও ভাঁজে ভাঁজে সবুজে সবুজে বানভাসি, জলোচ্ছ্বাসে তাড়িত, জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে বস্তি গড়ার সুযোগ দিয়ে ভূমিদস্যুদের একটি পক্ষ পাহাড়কে দখল করে ফেলছে। ধ্বংস করে চলেছে পাহাড়, তার প্রকৃতি এবং সবুজ ও এর নান্দনিকতা। নিকট অতীত পাহাড় বিপর্যয়ের অমানবিক, অনৈতিক ইতিহাসকে বহন করে চলেছে। এই পাহাড়ের ধসেই ২০০৭ সালে চরম মূল্য দিতে হয়েছে মানবতাকে। ২০০৮ থেকে ২০১৭- প্রতিটি সালেই কমবেশি চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। আমরা অতীতে খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছি। বসেছি, ভেবেছি, চষেছি, উদ্বিগ্ন হয়েছি। আলোচনা হয়েছে, পর্যালোচনা হয়েছে। খসড়া নীতিমালা, বিধিমালা হয়েছে। সংকটের কাঙ্ক্ষিত সমাধান হয়নি। সমাধানের ধারেকাছেও আমরা পৌঁছাইনি।

কাল যে পাহাড়টি দাঁড়িয়ে ছিল উন্নত শিরে, আজ তা সমতলের নিষ্ঠুরতায় কোদাল-গাঁইতি-শাবলের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা, তাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের কথা আমরা ভাবিনি। আজও ভাবছি না ২০৩০ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের কথা। সবুজের প্রাকৃতিক সত্তাকে সৃষ্টি করা যায় না। পাহাড়ের নিবিড় মৌনতাকে তৈরি করা যায় না। আমরা সব জায়গায় হাত দিচ্ছি, নষ্ট করছি, বিচ্ছিন্ন করছি। বিচ্ছিন্ন করছি দেহ থেকে হৃদযন্ত্রকে। বিচ্ছিন্ন করছি জীবনের স্পন্দন থেকে ফুসফুসকে। বিচ্ছিন্ন করছি বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎকে। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক