সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ (সিটি করপোরেশন) সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বর্তমান আইনে মেয়ররা নতুন করে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে পদত্যাগের বিধান রয়েছে। কিন্তু তারা যেন স্বপদে থেকেই অর্থাৎ পদত্যাগ না করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, এমন চিন্তা করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। যদিও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছেন, এখনও এ ব্যাপারে তারা ভাবছেন না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরেই জেনেছি, এজন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বরাত দিয়ে একটি দৈনিকে প্রকাশ, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে মেয়রদের পদে বহাল রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন। মন্ত্রী ও সচিবের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হলেও এ ব্যাপারে অর্থাৎ এ আইনের সংশোধন কার্যক্রম শুরুর আগে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আরও ভাবার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।

মেয়রদের স্বপদে বহাল রেখে নির্বাচন করা হলে তাতে নির্বাচন ব্যবস্থা আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। গণতন্ত্রের জন্যও তা হবে বুমেরাং। এমনিতেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম অভিযোগ আছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে গেছে- এই অভিযোগও কম পুষ্ট নয়। কী করে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নমুক্ত করা যায়, এ ব্যাপারেও এর আগে এই কলামেই লিখেছি। ভোট ও ভোটারের মর্যাদা কেন কমে গেল, কী করে ক্রমেই তা অধিকতর প্রশ্নবিদ্ধও হলো, তাও সচেতন মানুষমাত্রই জানা। গণতন্ত্রে নির্বাচন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। নির্বাচন গণতন্ত্রের অলঙ্কার। বর্তমান সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো গঠিত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। ওই নির্বাচন নিয়েও নানা রকম নেতিবাচক কথা আছে। ২০১৪ সালের পর থেকে দেশের নির্বাচন পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলেও এ কথাও অসত্য নয় যে, এ সময়ে অনেকটাই স্বচ্ছ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনও হয়েছে। সামনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনসহ কয়েকটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনগুলোতে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশগ্রহণের কথা আপাতত জানালেও একই সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের আস্থাহীনতার কথাও জানিয়েছে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রবিমুখ হওয়ার চিত্র ফের দেখা গেছে ঢাকা সিটির বিগত জোড়া নির্বাচনে। ভোটদানে ভোটারের আগ্রহহীনতার যে চিত্র দেখা গেছে, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভবার্তা নয়।

দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার যে উদ্যোগ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় নিচ্ছে, তা ভালো উদ্যোগ হলেও কেমন হবে ওই নির্বাচন, এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমি স্পষ্টতই মনে করি, মেয়রদের পদে বহাল রেখে নির্বাচন করার চিন্তাটা মোটেও উচিত হবে না। এর ফলে যে শুধু আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রটাই বিস্তৃত হবে তাই নয়, আরও নেতিবাচকতারও আশঙ্কা থেকে যায়। আর যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা না যায়, তাহলে তাদের পদে না রেখে নির্বাচন করলেও নেতিবাচকতার আশঙ্কার নিরসন করা যাবে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তারা যদি এর যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে নির্বাচন স্বচ্ছ করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে (জাতীয় ও স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে) আমরা নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা দেখেছি, তা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্য যে কোনো মূল্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার কোনো বিকল্প নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঘটেছে এবং নানা সূচকে আমাদের অবস্থান আশাব্যঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, তা আমাদের অর্জনের বিসর্জনের পথও রচনা করেছে। এই বাস্তবতা দায়িত্বশীলরা অস্বীকার করতে চাইলেও এর অবকাশ যে নেই, তাও তাদের আমলে রেখে সেই প্রেক্ষাপট কিংবা নিরিখেই সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা বাঞ্ছনীয়। মনে রাখা দরকার, আত্মতুষ্টি আত্মসংশোধনের পথ সংকুচিত করে।

আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরগুলো শক্তিশালী করার দাবি নতুন নয়। আমরা জানি, দুই ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আমাদের দেশে বিদ্যমান। তাহলো গ্রামীণ ও নগর স্থানীয় সরকার। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামীণ স্থানীয় সরকার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। আর পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নগর স্থানীয় সরকারের কাঠামোভুক্ত। আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে 'স্বশাসন' প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই নিহিত ছিল। কিন্তু কার্যত তা কতটা সম্ভব হয়েছে এর উত্তর নিহিত রয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যেই। সমস্যা যেখানে সমাধানও সেখানেই- এই লক্ষ্যেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কিংবা লক্ষ্য হলেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শে প্রতিবদ্ধকতার দেয়াল এখনও ভাঙা যায়নি। স্থানীয় নেতৃত্ব, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের আরও ক্ষমতায়নের বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে নানা মহলে গুরুত্ব সহকারে ফিরে ফিরে আলোচনায় আসছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও নানাবিধ জটিলতা বিদ্যমান। স্থানীয় সরকারের অসহায়ত্ব নানাভাবেই ইতোমধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। বহুদিন ধরেই স্থানীয় সংস্থাগুলোর ক্ষমতা খর্ব করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পরিপূর্ণভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।

স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো আমাদের সমাজ, রাজনীতি এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় হতে পারত ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান- এমন কথা অমূলক নয়। কিন্তু তা না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে এর বিপরীত। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে এই সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। এর ফলে ক্ষতিটা হয়েছে তৃণমূলে উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে। সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নাক গলানোর ফলটা যে কল্যাণ বয়ে আনেনি, এমন দৃষ্টান্তও তো আছে। এসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত না করে মেয়রদের স্বপদে বহাল রেখে নির্বাচন করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। ক্ষমতার সঙ্গে স্বার্থের বিষয়টি কীভাবে জড়িত, তাও আমরা নানাভাবেই এ পর্যন্ত কম দেখিনি। জাতীয় সংসদের সদস্যরা যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, তেমনি উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়ররাও সমভাবেই নির্বাচিত প্রতিনিধি। অর্থাৎ সবাই ভিন্ন ভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যদি নিজেদের ক্ষমতাবলে কাজ করার কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে আমরা তৃণমূলের উন্নয়ন-অগ্রগতির আশা করি কী করে? সংবিধানে বর্ণিত বিধিবিধান আর বিদ্যমান পরিস্থিতির ফারাক ঘোচাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন দুরূহ।

আমি মনে করি, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন যাতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অধিকতর গতিশীল ও শক্তিশালী হয়। আর এ জন্য মেয়রদের স্বপদে রেখে নির্বাচন করার নিধান করে আইন করার কোনোই প্রয়োজন নেই। এই চিন্তাটা কোনো শুভ চিন্তা নয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থা স্বচ্ছ কিংবা প্রশ্নমুক্ত করার দাবিটি যখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে, তখন এমন বিতর্কিত উদ্যোগ নেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে বলে মনে করি না। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জন যদি আমরা চাই, তাহলে সমন্বিত প্রচেষ্টা যেমন প্রয়োজন, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা সিপিডি যে পরামর্শমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাও আমলে নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এসডিজি) স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্তরগুলোর ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে। বহুপক্ষীয় অংশীদারিত্ব গড়েই কেবল এসডিজি অর্জনে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। আর এজন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্তরগুলোর ব্যবহারও সেই নিরিখেই নির্ণয় করা যেতে পারে।

গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো বিদ্যমান, সেসবের নিরসনে মনোযোগ বাড়াতে হবে। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নির্বাচন প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থা অস্বচ্ছতার কাঁটায় বিদ্ধ হয় এমন যে কোনো কাজ কিংবা উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর নিরসনে যদি সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষ মনোযোগ দেয়, তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। নির্বাচনী ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার পথে নতুন করে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করাই হবে শুভবোধের পরিচয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন