সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে হোস্টেল থেকে বাসায় ফিরেছি। এ সময় পরিচয় তৎকালীন ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা গোবিন্দ ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি তখন ঢাকা কলেজের কোনো এক ঘটনায় গ্রেপ্তার এড়াতে আমার নানার বাসায় আত্মগোপন করে ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি আমার আরও কিছু ক্যাডেট বন্ধুসহ আরও র‌্যাডিক্যাল লাইনের ভক্ত। আমরা বাড়ি থেকে কলেজে ফেরার সময় ট্রাঙ্কের তলায় কাপড়ের নিচে লুকিয়ে নিয়ে যাই 'সিরাজ সিকদারের রচনাবলি'। বিবেচনা ছিল দেশের অগণিত খেটে খাওয়া মানুষের অর্থানুকূল্যে লেখাপড়া করছি। তাদের জন্য আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ফিরে যাই। ছুটিতে বাড়ি আসি। ইতোমধ্যে নানাভাবে পরিচয় ঘটে গেছে বেশ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কর্মসূচিতে যাই।

ক্যাডেট কলেজের চার দেয়ালের মাঝে বাইরের জগৎ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন। ভরসা তখন শুধু দৈনিক পত্রিকা। সে আমলে ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ছাড়া অন্য পত্রিকা আমরা পেতাম না। ১৯৮৪ সালের মার্চের ২ কিংবা ৩ তারিখ দৈনিক বাংলায় খবর- 'শ্রমিক নেতা' তাজুল ইসলাম নিহত। কে তিনি, জানি না, চিনি না। শুধু জানলাম, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির অধিকারী। একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। হরতাল সংগঠিত করতে গিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল সাদুর গুন্ডা বাহিনীর হাতে নিহত। কমরেড তাজুল হয়ে উঠলেন আমার নায়ক। আপনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম, তাজুলের সংগঠনই হবে আমার সংগঠন। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করব; আমি কমিউনিস্ট পার্টি করব।

১৯৮৪ সালের ১ মার্চের পর বিগত হয়েছে ৩৬ বছর। মিছিল-স্লোগানে অসংখ্যবার বলা 'আমরা সবাই তাজুল হবো' অথবা দেয়াল লিখন 'কমরেড তাজুলের রক্তমাখা শার্ট আমাদের আদর্শের পতাকা' শব্দগুচ্ছ যখন স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তখন নিজের সঙ্গে হিসাব মেলাতে বসি। আমার কৈশোরের বিপ্লবী স্বপ্ন আর অঙ্গীকার থেকে আমি কত দূরে, সেটাই ভাবি। শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়; আমার প্রজন্মের সবাই, আমরা যারা '৮৪, '৮৫, '৮৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছি; আমাদের নায়ক, আমাদের আদর্শ কমরেড তাজুল। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখতাম- আমরা তাজুলের মতো সার্বক্ষণিক বিপ্লবী হবো। সিপিবির চতুর্থ কংগ্রেসের খসড়া দলিলের সেই '২০০০ সালের মধ্যে বিপ্লব'-এর গোপন আকাঙ্ক্ষা আমরা মনে ধারণ করতাম।

অসংখ্য বীর কমরেডের আত্মদান, আত্মত্যাগে আমাদের পার্টি এবং আমরা ধন্য। নানা পাওয়া, প্রতিষ্ঠা, সচ্ছলতাকে পায়ে মাড়িয়ে অসংখ্য কমরেড সমগ্র জীবনকে সমর্পণ করেছেন পার্টির জন্য, বিপ্লবের জন্য। অনেকে কিছু না পেয়ে, কিছু না হয়েই বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাদের মধ্যে কমরেড তাজুল আমাদের তরুণ সময়ের নায়ক। তিনি মেহনতি সর্বহারাদের কাছে ত্রাতা হিসেবে নয়; গিয়েছিলেন তাদেরই একজন হিসেবে তাদের মাঝে জায়গা করে নিতে। গায়ে খাটা শ্রমিক হিসেবে শ্রমিক আন্দোলন তিনি সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষিত যুবক উচ্চশিক্ষিত স্ত্রীকে নিয়ে উঠলেন শ্রমিক কলোনিতে। দু'সন্তানকে রাখলেন নিজের কাছে। তার সর্বস্ব নিবেদিত ছিল বিপ্লবের জন্য। এটাই আকৃষ্ট করেছিল আমাকে এবং আমাদের প্রজন্মকে।

কমরেড তাজুল জন্মেছিলেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। পারিবারিক সংকট তাকে নানা বিপর্যয়ে ফেললেও অধ্যবসায়ের কারণে তিনি প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স, মাস্টার্স করেও তিনি হন শ্রমিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রত্ব ছাড়তে হয় তার জীবনসঙ্গী আমাদের নাছিমা আপাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কমরেড তাজুল ইসলাম থাকতেন সলিমুল্লাহ হলে। সেখানে সংগঠিত হন কমিউনিস্ট পার্টির গ্রুপে। গ্রুপে ছিলেন ৫ জন- তাজুল, নিজামউদ্দিন আজাদ, লুৎফুল আজিম, মিজান, কালাম। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই সলিমুল্লাহ হলে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে শহীদ হন লুৎফুল আজিম। মুক্তিযুদ্ধে ১০ নভেম্বর বেতিয়ারায় সম্মুখ সমরে শহীদ হন নিজামউদ্দিন আজাদ। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে শহীদ হন তাজুল ইসলাম। ওই পার্টি গ্রুপে যারা ছিলেন এখন তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আর তাজুল ভাইয়েরই আত্মীয় মিজান ভাই।

নিজের দুর্বিষহ শৈশব, যেখানে শুধু দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর অনাহারের স্মৃতি; তা কমরেড তাজুলকে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার মোহ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। সামষ্টিক মুক্তির সঙ্গে তিনি তার মুক্তিকে যুক্ত করে নিতে পেরেছিলেন বলেই নির্দি্বধায় শ্রমিক হতে পেরেছিলেন। নিজের মধ্যবিত্ত মুখোশকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। নিজেই নিজের ওপরে ওঠার সিঁড়িকে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রয়াত নাছিমা আপা প্রায়ই বলতেন, একবার তিনি তার এক দুলাভাই, যিনি ছিলেন আর্মি মেডিকেল কোরের প্রধান, তার প্ররোচনায় শহীদ তাজুলকে আর্মিতে ওষুধ সরবরাহের ঠিকাদারির জন্য অনুরোধ করেছিলেন। উত্তরে তাজুল তাকে বলেছিলেন, 'নাছিমা, বিপ্লবীর স্ত্রী হতে হলে তোমাকে এখনও অনেক সাধনা করতে হবে।' নাছিমা আপাকে দেখেছি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই সাধনা জারি রেখেছেন। বিপ্লবীর স্ত্রী হিসেবে দুটি ছেলেকে নিয়ে দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে তিনি চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় একবারের জন্যও তিনি হতাশা ব্যক্ত করেননি। তাজুলের স্বপ্নকে কখনোই ব্যর্থ বলেননি।

আজ কোথায় গেল আমাদের তাজুল হওয়ার স্বপ্ন! কতগুলো জটিল, নানা বাস্তবতার ধুয়া তুলে আমরা নিজেদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সর্বস্ব ত্যাগের যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নে ছিল, আজ তা পরিবর্তিত হয়েছে ক্যারিয়ারের সিঁড়ি ভাঙার অধ্যবসায়ে। আমরা কমরেড তাজুলের ব্যর্থ অনুসারী। তাজুলকে ভালোবেসেছিলাম তার নির্মোহ চরিত্রের কারণে। কিন্তু আমরা নিজেরাই ক্রমান্বয়ে তলিয়ে যাচ্ছি ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার চোরাবালিতে। চাকরি, ব্যবসা ক্রমান্বয়ে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের বিপ্লবী হওয়ার প্রচেষ্টাকে।

আজ বিশ্বায়নের নামে সারা পৃথিবীতে চলছে একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজির অবাধ আগ্রাসন। নয়া উদারনীতিবাদ পৃথিবীর দেশে দেশে জন্ম দিচ্ছে নয়া ফ্যাসিবাদী শাসন। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থে একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লুটে নিতে চায় আমাদের জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস। সাম্প্রদায়িক শক্তিও আজ সুযোগ বুঝে পক্ষ বদলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। লুটেরা ধনিকরা যথেচ্ছভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত, প্রকল্পসহ সবকিছু লুটপাটে মেতে উঠেছে।

দেশ-জাতির এ ক্রান্তিকালে একটি বিপ্লবী গণজাগরণ আজ সময়ের দাবি। ৩৬তম তাজুল দিবসে আমরা কি আমাদের স্বপ্ন পুনর্নির্মাণ করব না- আমাদের প্রজন্ম এবং অনুজদের প্রতি এ প্রশ্ন রাখতে চাই।

কমরেড তাজুল আমাদের পথ চেনানো তারা। আমাদের কালের নায়ক। কমরেড তাজুল লাল সালাম।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সিপিবি