মানুষের আবির্ভাব প্রকৃতিকে যেমন পূর্ণতা দিয়েছে, তেমনি মানবসভ্যতার প্রগতির বাসনায় মাত্রাতিরিক্ত উপাদান আহরণ প্রায়ই বিপর্যস্ত করেছে প্রাকৃতিক পরিবেশকে। আবার খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস কিংবা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাঝেমধ্যেই থমকে দিয়েছে সভ্যতার গতি। মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক এই নির্ভরশীলতাকে উপলব্ধি করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্ববাসী প্রকৃতির মৌল উপাদানগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে ব্রতী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী ইরানিয়ান শহর রামসারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রাণ এবং প্রকৃতির অপরিহার্য উপাদান 'জলাভূমি'র সংরক্ষণ ও প্রাজ্ঞচিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন, যা কনভেনশন ওন ওয়েটল্যান্ডস বা রামসার কনভেনশন নামে পরিচিত। রামসার কনভেনশন ১৯৭৫ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭১টি দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। জলাভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে রামসার কনভেনশন গৃহীত হওয়ার তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

রামসার কনভেনশনের আর্টিকেল ১.১-এ জলাভূমি বলতে বোঝানো হয়েছে নিচু ভূমি; যার পানির উৎস প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম, পানির স্থায়িত্বকাল সারা বছর বা মৌসুমভিত্তিক, পানি স্থির বা গতিশীল, স্বাদু, আধা লবণাক্ত বা লবণাক্ত। এ ছাড়াও কম গভীরতাসম্পন্ন সামুদ্রিক এলাকা, যার গভীরতা ছয় মিটারের কম ও অল্প স্রোতযুক্ত। রামসার কনভেনশনে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকৃতির জলাভূমিগুলোকে তিনটি গ্রুপে ও ৪২টি ক্যাটাগরিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে করে সংশ্নিষ্ট দেশগুলো জলাভূমিগুলোকে তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। কারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় জলাভূমির প্রভাব বহুমাত্রিক। জলাভূমি স্থানীয় পানিচক্র ও কার্বনচক্রকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে আবহাওয়ার উষ্ণায়ন প্রতিরোধে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণে প্রাকৃতিক শোধনাগারের ভূমিকায় থাকে জলাভূমি। জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানসহ বহুবিধ প্রয়োজন মেটানো, এমনকি মানুষের জীবনাচরণেও জলাভূমির প্রভাব দৃশ্যমান। কখনও কখনও জলাভূমিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় সংশ্লিষ্ট জনপদের সংস্কৃতি। মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামে জলাভূমির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত চলমান টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এসডিজি-৬-এর টার্গেট ৬.৩ ও ৬.৪-এ জলাভূমি সংরক্ষণে সুস্পষ্ট নির্দেশনার উলেল্গখ ছাড়াও অন্তত ১০টি অভীষ্টের সঙ্গে জলাভূমির সংরক্ষণ ও এর টেকসই ব্যবহারের বিষয়াদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই বিলীন করছে জলাভূমি। ২০১৫ সালে জানা যায়, গত এক শতাব্দীতে বিশ্বের ৬৪ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ জলাভূমি বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৭২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ রামসার কনভেনশনে স্বাক্ষরের মাধ্যমে জলাভূমি সংরক্ষণের বৈশ্বিক উদ্যোগে শামিল হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে রামসার সাইটের তালিকাভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ওই সাইটগুলোসহ সার্বিকভাবে জলাভূমির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম সহজতর করতে প্রণয়ন করেছে 'প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০', 'ভূমি ব্যবহার নীতিমালা-২০০১ এবং 'পানি আইন-২০১০-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধি। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ট প্রটেকশন কনভেনশন এবং ১৯৯২ সালের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত কনভেনশনসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক দলিলেও স্বাক্ষর করেছে। সরকার দেশজ মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৭৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত জলাভূমিতে ৫৬টি মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অদূরদর্শী শিল্পায়নের ফলে প্রতি বছরই বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জলাভূমি হয় বিলীন হচ্ছে, নয়তো মারাত্মক দূষণের শিকার হয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। গত পাঁচ দশকে ঢাকা মহানগরীর চারপাশের জলাশয়গুলো বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়া বিশ্নেষণ করলে আমাদের জলাভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা অনেকাংশেই স্পষ্ট হবে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কেবল স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকেই বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জলাভূমি বিলীন হয়ে গেছে। দেশের মধ্য অঞ্চলের চলন বিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই সমতল ভূমিতে কিংবা ছোট ছোট পুকুরে পরিণত হয়েছে। অথচ এটি অনস্বীকার্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বৈশ্বিক উন্নয়ন পথযাত্রায় দেশকে অগ্রবর্তী ভূমিকায় পৌঁছে দিতে আমাদের প্রয়োজন সুস্থ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। আর এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের জন্য জলাভূমিগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও জলজসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন।
এমতাবস্থায় জলাভূমির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত দেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি অধ্যুষিত হাওর জনপদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরমেয়াদি হাওর মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। জলাভূমি সংক্রান্ত সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে অধিদপ্তর ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় আনয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি' গঠন করা হয়েছে। এত কিছুর পরও বাংলাদেশ জলাভূমির দূষণ ও শ্রেণি পরিবর্তনের গতি প্রতিরোধে কাম্য স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনার কথা বলছি, কারণ মানুষ যেমন প্রকৃতির অংশ, তেমনি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিটি উপায়-উপকরণের উৎসও প্রকৃতি। মানব জাতির প্রগতির অভিযাত্রায় সফলতার মুকুটে প্রকৃত অর্থে তখনই নতুন পালক যোগ হয়েছে, যখন মানুষ প্রকৃতির নিয়মকে শাশ্বত মেনে নিয়ে পথচলার চেষ্টা করেছে। অতএব, জীববৈচিত্র্যের আধার জলাভূমি সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রকৃতিভিত্তিক লাগসই পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি।

সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ

frkhan62@yahoo.com