- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসা ও ক্রসফায়ার
নিরাপত্তা
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসা ও ক্রসফায়ার

গত ৩ মার্চ সমকালে প্রকাশ, কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা ও শালবন পাহাড়ে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গত ২ মার্চ ৭ জন রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হয়েছে। একই দিনে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে আরেকজন মাদক ব্যবসায়ী। দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যা ২০০৭ সালে যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে প্রকট আকার লাভ করে, সেই সময় থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ আসতে শুরু করে যে, এ দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা একদিকে যেমন জীবন রক্ষার তাগিদে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে বসবাসের অধিকারসহ অবারিত সুবিধাপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে দিন দিন বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। আজকে আমাদের দেশে সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার যে চরিত্র ধারণ করেছে, এর পেছনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করা যায়। আসলে মাদক ও সন্ত্রাসের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এ দুটি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মাদক ব্যবসায়ী এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্তরাই সন্ত্রাসবাদের অন্যতম জোগানদাতা।
আমরা নিকট অতীতে বিভিন্ন সময় দেখেছি, এসব মাদক ব্যবসা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাস দমনে সরকারের তরফ থেকে ব্যবস্থা নিতে গিয়েও ক্ষণে ক্ষণে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৬৬ জন নিহত হয়েছে। যারা মারা গেছে তারা সবাই যে মাদক ব্যবসা কিংবা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ ২০১৮ সালে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরাম যখন হত্যার শিকার হন, তখন থেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন আরও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ্য করি, এর সঙ্গে যেসব রাঘববোয়াল জড়িত রয়েছে, তাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিন পেয়ে যায় কিংবা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের রক্ষা করে যাচ্ছে।
যা হোক, আলোচনা শুরু করেছিলাম র্যাব কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধে ৭ ডাকাত নিহত হওয়া নিয়ে। সন্ত্রাস দমনে বিশ্বব্যাপী পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপরাধীদের মৃত্যু অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। রোহিঙ্গা শিবিরেও এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, কখনও নিজেদের মধ্যে সংঘাতে কিংবা কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে। এখানে মূলত দুটি বিষয় আমাদের গভীরভাবে ভাবাচ্ছে। একটি হলো, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে কক্সবাজার ও আশপাশের পাহাড়গুলোতে রোহিঙ্গাদের তৎপরতা এবং ২০০৭ সালের পর থেকে দেশি সন্ত্রাসীদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এর ব্যাপকতা লাভ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলের নামে যথেচ্ছ বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ড। প্রথমটি নিয়ে আলোচনা করলে আমরা বলতে পারি, বছরের পর বছর ধরে স্থানীয়রাসহ সচেতন মানুষ মাত্রই রোহিঙ্গা সংকটের কারণে আমাদের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে সর্বাগ্রে বনভূমি উজাড় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। এর সঙ্গে রয়েছে সেখানে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা। বিষয়টি একদিনে হয়ে ওঠেনি। যদি দাবি করা হয়, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেরাই এ ধরনের ব্যবস্থা কায়েম করেছে, তাহলেও ভুল হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই স্থানীয়দের স্বার্থসংশ্নিষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উদারতা ও বদান্যতায় যেসব রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয়সহ মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করে আসছে, তাদের আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন মেনে অবশ্যই শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে থাকার কথা। কোনোভাবেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে তাদের আশ্রয় শিবিরের বাইরে থাকার কথা নয়। সেখানকার শিবিরগুলো পরিদর্শন করে যে বিষয়টি সবার আগে নজরে আসবে তা হচ্ছে, তাদের চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো রকমের বিধিনিষেধ মনিটরিং করা হচ্ছে না।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল বিষয়ক আইনি যে ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে, এর ফলে একের পর এক প্রাণ গেলেও এ বিষয়ে উলেল্গখযোগ্য কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আগেই উলেল্গখ করেছি, সাম্প্রতিক ঘটনায় যে ৭ জন রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হয়েছে, এদের সবাইকে ডাকাত, সন্ত্রাসী ও যে একজন মাদক চোরাকারবারি নিহত হয়েছে, তাকেও চোরাকারবারি হিসেবে স্থানীয় শিবিরগুলোর অধিবাসীরা চিহ্নিত করেছে। এরা অপরাধী ও এদের অপরাধের মাত্রা নিয়ে হয়তো তেমন সন্দেহ নেই। এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত ভাবনার সেটি হচ্ছে, এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে কতটুকু সন্ত্রাস এবং মাদক ব্যবসাকে লাঘব করা যাবে। ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ সমস্যার কোনো ধরনের সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। আজ এই কথিত বন্দুকযুদ্ধে যারা মারা গেল, এর মাধ্যমে অন্যায়ের বিশাল বৃক্ষের কিছু ডালপালা ছাঁটা হলো মাত্র; সে বৃক্ষটি কিন্তু আগের জায়গাতেই রয়ে গেল। অচিরেই সেখানে হয়তো নতুন ডালপালা প্রতিস্থাপিত হবে। আমাদের দরকার হচ্ছে, সন্ত্রাস দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আর তা হতে হবে আইনের বিধান মেনে। কক্সবাজারের বন্দুকযুদ্ধে যে ৭ জন মারা গেল এ ধরনের বন্দুকযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া বন্দুকযুদ্ধ কিংবা ক্রসফায়ার অথবা এনকাউন্টারে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৬শ' ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস দমনে এ ধরনের পদক্ষেপের খুব একটা সুফল আমরা পাইনি। উপরন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ ধরনের ঘটনা সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকেও সমালোচিত করছে।
এখানে মাদক ও সন্ত্রাসবাদ আমাদের সমাজের জন্য যতটুকু ক্ষতিকর, এ দেশে আশ্রয় গ্রহণ করা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্রমাগত নেতিবাচক তৎপরতা সার্বিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছাকে পুঁজি করে যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসব কর্মে নিয়োজিত রয়েছে, তাদের মূলোৎপাটন যতক্ষণ না সম্ভব হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের পদক্ষেপের সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, শরণার্থী শিবিরসহ আশপাশের স্থানীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকট যেভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইনের শাসনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তা সম্ভব না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে তাদের আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।
সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন