- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এবং জনমিতির সুবিধা
বিশ্ববিদ্যালয়
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এবং জনমিতির সুবিধা

কেন আমরা ভর্তিযুদ্ধের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় দরিদ্র পরিবারগুলোকে আরও সর্বস্বান্ত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছি? বেশ ক'বছর আগে ড. জাফর ইকবাল প্রস্তাবিত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি যখন আলোচনায় এলো, আনন্দিত হলাম এবং যখন এটি কার্যকর হলো না, তখন কষ্টও পেলাম। সেই আমি এখন কেন কেন্দ্রীয় বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি? কেন এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের জন্য হঠকারী হবে, তা আমি পর্যায়ক্রমে তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথমে আসি স্বতন্ত্র পরীক্ষা নেওয়ার বিপক্ষে যে অভিযোগগুলো আছে তার যথার্থতা ব্যাখ্যায়।
১. অভিযোগগুলোর অন্যতম হচ্ছে :জাতি কি এ কথা বিশ্বাস করবে যে, ২০১৯ সালে ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে সিলেকশন গ্রেডের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের আয় ছিল নয় হাজার টাকা। ২০১৮ সালে এ পদের একজন অধ্যাপক সপ্তাহখানেকের পরিশ্রমের পর ১০০টি প্রশ্ন এবং তার উত্তর তৈরি করার জন্য তার 'মজুরি' ছিল তিন হাজার টাকা। ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে কেটে রাখা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় নির্বাহের জন্য, তা এই পরীক্ষা সংক্রান্ত ও পরীক্ষাবহির্ভূত খাতও। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্দেশ আছে ব্যয় নির্বাহের জন্য নিজস্ব খাত তৈরির। এই হলো শিক্ষকদের 'বিপুল অর্থ প্রাপ্তি'। এই যদি হয় শিক্ষকদের আয়, তা হলে কোন স্বার্থে তারা সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন? এই স্বার্থটি হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া শাক দিয়ে ভাত খাওয়া সেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া। স্বার্থটি হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এই সুবর্ণ সময়ে মেধাবী তরুণদের সুযোগ করে দেওয়া প্রকৃত শিক্ষা ও নির্মোহ মননের মিশ্রণে দেশকে গড়ে তোলার (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মূল কথা হচ্ছে- একটি দেশের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশটি হবে তরুণ এবং একটি রাষ্ট্রের জীবনে একবারই এই সুযোগ আসে, যার স্থায়িত্ব হয় ২০-৩০ বছর। এই সময়ে যদি তরুণদের প্রকৃত শিক্ষা ও সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে গড়ে তোলা না হয়, তবে সেই দেশ উন্নত হওয়ার সুযোগ চিরতরে হারাবে)। সে কারণেই শিক্ষকদের স্বার্থটি হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা পাচার রোধ করা।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় এবং কেন কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় 'ঐতিহ্য' ও 'পবিত্রতা' দাবি করে? আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি। আমরা শিক্ষার গুণগত মান ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করি না; তবে 'ঐতিহ্য' ও 'পবিত্রতা' রক্ষার দাবি অবশ্যই করি। প্রথমে জানাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফ্যাকাল্টির পরীক্ষা দু'দিনে সম্পন্ন হয়। সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ, আইন অনুষদ, চারুকলা অনুষদের সব বিভাগের এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বা দু'জন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রায় ১০০টি করে প্রশ্ন নেওয়া হয়। আরেক দল শিক্ষক কর্তৃক রুদ্ধদ্বার কক্ষে এক সভায় প্রায় প্রত্যেকের প্রশ্ন থেকে এক-দুটি করে প্রশ্ন নিয়ে নতুন আরেকটি প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। এ রকম কয়েকটি সেট প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। আরেকটি ছোট দল রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রশ্নপত্র কম্পোজ, ছাপানো, খামে ভরে সিলগালা করা এক বসায় সম্পন্ন করে। তাদের সঙ্গে মোবাইল বা এ জাতীয় কোনো ডিভাইস রাখা এবং বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কখনও সারারাত জেগে কাজ করে পরের দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেওয়ার পর তারা কক্ষ থেকে বের হন। পরীক্ষার হলে পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকেন যে শিক্ষকরা, এমনকি প্রবীণতম শিক্ষক, তারা অনবরত হাঁটাহাঁটি করেন, পরীক্ষার্থীদের ঘাড় ঘুরানোর সুযোগও দেন না। এটি হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য ও পবিত্রতা, যার কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ভর্তিতে অনিয়মের কোনো অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারবে না। শিক্ষক নিয়োগ, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ইত্যাদির অভিযোগ থাকলেও ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রটি আজও পবিত্র ও স্বচ্ছ। এখানে প্রতিটি ধাপে জবাবদিহির ক্ষেত্র স্পষ্ট ও চিহ্নিত। সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ায় এটি কীভাবে বিঘ্নিত হবে, তা ব্যাখ্যা করি। নতুন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যাদের এত বড় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মতো অবকাঠামো বা জনবল নেই।
৩. সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিশাল একটি প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি ধাপ ও প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা থাকবে, যেখানে কোনো একটি ধাপে জালিয়াতি বা প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ছাড়া সেখানে রাজনৈতিক আধিপত্য বা প্রভাবশালী মহলের সুযোগ থাকবে তা ধামাচাপা দেওয়ার, যা স্বতন্ত্র পরীক্ষায় সম্ভব নয়। এখানে সুপারিশে ভর্তির সুযোগও চলে আসবে।
৪. সমন্বিত পরীক্ষায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দ্বারা পরীক্ষা কেন্দ্র দখল, নকল, জালিয়াতির আশঙ্কা থেকে যায়। এতে একদিকে কম মেধাবী, রাজনৈতিক কর্মীর ভর্তির সুযোগ যেমন চলে আসে, তেমনি পরিদর্শকদের জীবন সংশয়ের সম্ভাবনাও থাকে। রাজশাহীতে অতি সম্প্রতি একজন অধ্যক্ষকে নকল করতে না দেওয়ার অপরাধে পুকুরে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে, তা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি।
৫. অধিকাংশ শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিপক্ষে থাকলেও কেন তারা এই পরীক্ষা নিতে বাধ্য হন? যখন তারা দেখেন অগণিত 'আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ' পাওয়া শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে এসে স্নাতক পর্যায়ের পড়া আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়; নিবিড় সাক্ষাৎকারে কেউ কেউ স্বীকার করে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে তারা কীভাবে বহিরাগতদের বা পরিদর্শকদের সহায়তা লাভ করেছিল। গণমাধ্যমেও আমরা দেখেছি, একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে আরেকজন পরীক্ষা দিয়েছে। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফল তৈরিতে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের অংশ যোগ করার বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।
৬. প্রশ্ন উঠছে, সেটের পরীক্ষা যদি সারাদেশে একসঙ্গে নেওয়া যায়, তবে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কেন নয়? আমেরিকা বা ইউরোপে কোথাও কি জিসিএস বা সমমানের পরীক্ষায় পরীক্ষা কেন্দ্র দখল, প্রশ্ন ফাঁস বা জালিয়াতি ঘটে? যেদিন পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে এসব অনিয়ম বন্ধ করে পরীক্ষার প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব হবে, সেদিন ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। এসব বন্ধ করার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকেও সেই কাতারে শামিল করার অর্থ হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার সর্বনাশের দিকে আরেক পা অগ্রসর হওয়া।
কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের আয় বাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ এ প্রক্রিয়া চালু হলে সেখানে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রশাসনে যুক্ত হবেন এবং সরকারের দেওয়া বরাদ্দ থেকে মোটা অঙ্ক পাবেন। বিপরীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বিরাট অংশের শিক্ষকরা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ভর্তি পরীক্ষায় কাজ করতে সম্মত থাকেন। ভোগবাদী মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষক দিয়ে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে মূল্যায়ন করা আরেকটি হঠকারিতা, যা সংকট সমাধানের পথকে আরও সংকুল করে তোলে। ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য সমন্বিত পরীক্ষা হবে মাথাব্যথা কমানোর জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো সমাধান। এখন প্রয়োজন কীভাবে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানো যায় সেই উপায় খুঁজে বের করা। নিল্ফেম্নাক্ত পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে :১. ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হোক। বাকি ব্যয় নির্বাহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত বরাদ্দ দেওয়া হোক; ২. একটি বিশাল অংশের শিক্ষকরা কোনোরকম পারিশ্রমিক ছাড়াই ভর্তি পরীক্ষার কাজ করতে সম্মত আছেন। এখানে কোনোরকম পারিশ্রমিক না রাখার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার বিষয়টি সব শিক্ষক বিবেচনায় আনতে পারেন; ৩. যেহেতু এটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জীবনের সঙ্গে যুক্ত, এ জন্য তাদের নিয়েও বিভাগ বা অঞ্চলভিত্তিক কর্মশালা ও নাগরিক সমাবেশের প্রয়োজন রয়েছে; যেখান থেকে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে; ৪. এই কেন্দ্রীয় বা সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে যে পরিমাণ মেধা, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হবে, তা শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোকে নকলমুক্ত ও স্থানীয় আধিপত্যমুক্ত রাখা, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার উদ্যোগের পেছনে ব্যয় করা হলে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না। আমাদের এখন সে পথেই হাঁটতে হবে, নতুন নতুন সংকট তৈরি করার চেয়ে; ৫. গণমাধ্যমকে প্রকৃত তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রচারে আরও দায়িত্বশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। অপপ্রচার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয় এবং সমস্যা সমাধানের পথকে দুরূহ করে তোলে।
সবশেষে একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা হবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটি বসানো। আর তার ফলে ঘটতে থাকবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা পাচার। নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ, নির্মোহ, যোগ্য শিক্ষকরা অভিবাসী হতে থাকবেন এবং দেশ পরিচালিত হতে থাকবে মেধাশূন্য ভোগবাদী, ক্ষমতামোহী প্রতিনিধিদের দ্বারা। দেশ হারাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবর্ণ সুযোগ।
অধ্যাপক; সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanamk@outlook.com
মন্তব্য করুন