বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবশেষে ফিরোজায় ফিরেছেন। করোনাভাইরাস নিয়ে সংবাদমাধ্যম যখন ব্যস্ত, মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী তার বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য 'মুক্তি' দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বলেছিলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির প্রায় বিস্মৃত ৪০১ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী আদেশে শর্তাধীন এই ব্যবস্থা। বিএনপি নেত্রী ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করাতে পারবেন, বিদেশে যেতে পারবেন না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সাড়ে পঁচিশ মাসের কারাবাস শেষে বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারা-কেবিন থেকে ছাড়া পান তিনি।
শুরুতেই 'অবশেষে' বলছি এই কারণে যে, খালেদা জিয়ার কারাবাসের শুরুতে বিএনপির আইনজীবী-নেতারা সেটাকে 'দুই দিনের ব্যাপার' আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়। পরের দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি, তাই নিয়মিত আদালত বন্ধ। আইনজীবীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসেই উচ্চ আদালতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন মিলবে। সেই রোববার হয়নি, পরের রোববারও চলে গিয়েছিল। তারপর শতাধিক রোববার চলে গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে যদিও নিয়মিত বিরতিতে আইনি লড়াই, রাজপথের লড়াই প্রভৃতি প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে; বাস্তবে খালেদা জিয়া মুক্তি পাননি।
বরং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় উচ্চ আদালতে বিএনপির আপিলের ফলে খালেদা জিয়ার সাজা পাঁচ বছর থেকে বেড়ে দশ বছর হয়েছিল। একই সময়ের মধ্যে আরেকটি, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, মামলায় আরও সাত বছর সাজা দেওয়া হয়েছিল। সবমিলিয়ে ১৭ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে প্রথম এক বছর নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগারে এবং পরবর্তী সময়ে শাহবাগের বঙ্গবন্ধুমেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্জন দিন কাটাচ্ছিলেন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং দেশের অন্তত দুইবারের প্রধানমন্ত্রী।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার 'সমঝোতা' হিসেবে খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হাতেগোনা কয়েকজন সংসদ সদস্যের শপথ ও অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শর্ত হিসেবেও খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা শোনা গিয়েছিল। প্রথম দিন সংসদে গিয়ে বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনও জানিয়েছিলেন। আমরা বিএনপি মহাসচিব ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে এ ব্যাপারে ফোনালাপও দেখেছি। যদিও কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছিলাম, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে তার পরিবারের সদস্যরা সক্রিয় হয়েছেন। তারা মাঝেমধ্যেই দেখা করে এসে তার স্বাস্থ্যের নাজুকতা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে তথ্য দিচ্ছিলেন। সর্বশেষ মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেখা করে এসে তার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন- 'এর পর তো তাকে জীবিত অবস্থায় এখান থেকে নিয়ে যেতে পারব কিনা, সেটাই আমাদের শঙ্কা। আমরা চাচ্ছি সরকার অন্তত মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দিক।' (সমকাল, ৮ মার্চ, ২০২০)।
বস্তুত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে কমবেশি বিভিন্ন মহলেই উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছিল। তিনি আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদি কিছু রোগে ভুগছিলেন। নির্জন কারাবাস স্বভাবতই সেসব রোগ যেমন গুরুতর করে তুলেছিল, তেমনই হতাশা ও অবসাদের জন্ম দিয়েছিল। যে কারণে তার বা বিএনপির রাজনীতির বিরোধী লোকজনও তার মুক্তির পক্ষে বলছিল নেহাত 'মানবিক' দিক বিবেচনা করে। বিস্মিত সংবাদমাধ্যমের জন্য মঙ্গলবার দ্বিতীয় তথ্য ছিল, এর মধ্যেই খালেদা জিয়ার ভাই ও বোন ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। অনুমান করা কঠিন নয়, সেখানেও তারা সেই 'মানবিক' আবেদনই তুলে ধরেছিলেন। খবরে প্রকাশ, তারপরই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা প্রয়োগের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। পরিবারের পক্ষ থেকেও মার্চের গোড়ায় এ-সংক্রান্ত একটি লিখিত আবেদন জানানো হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
যাহোক, আন্দোলন নয়, আইনি লড়াই নয়, রাজনৈতিক সমঝোতা নয়; শেষ পর্যন্ত পরিবারই খালেদা জিয়াকে 'মুক্ত' করতে সক্ষম হলো। বিশ্বব্যাপী যখন পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই কমে আসছে, তখন পরিবারের পক্ষে নানা প্রচার ও স্লোগানও বাড়ছে। এর একটি বেশি জনপ্রিয়- 'সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনও পরিবারের দরজা খোলা থাকে'। রাজনৈতিক দলকেও অনেক সময় নেতা-নেত্রীরা 'পরিবার' আখ্যা দিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে বিএনপি নিঃসন্দেহে একটি বড় পরিবার। আর সেই পরিবারের প্রধান খালেদা জিয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নয়, তার জৈবিক পরিবার কেবল নিজেদের দরজা খোলা রাখেনি, কারাগারের রুদ্ধ দরজাও খুলতে পেরেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে- খালেদা জিয়ার মুক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগ কতটুকু? মুখে যাই বলুন না কেন, বাস্তবে খালেদা জিয়ার নাজুক স্বাস্থ্য খোদ ক্ষমতাসীন দলের জন্যও শাঁখের করাত হয়ে উঠেছিল। খোদা না খাস্তা, কারাগারে থাকতেই যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত, আওয়ামী লীগের জন্য এর রাজনৈতিক মাশুল হতো ব্যাপক। এটা ঠিক, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সময়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য নতুন নতুন মামলা, হামলা ও ফেরার জীবন ছাড়া কার্যকর কিছু হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতির সঙ্গে কারাগারের অঘটন-পরবর্তী পরিস্থিতি তুল্য হতে পারে না। খালেদা জিয়ার নিজের ও তার নেতৃত্বাধীন দলের বর্তমান পরিণতির সঙ্গে অতীতের রাজনৈতিক ভুল কতখানি দায়ী, সেই বিচারে খুব বেশি মানুষ যেতেন না বলেই মনে হয়।
খালেদা জিয়া যদি জামিনেও মুক্তি পেতেন, তা হতো আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক বেকায়দা। ওই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে প্রায় বিধ্বস্ত বিএনপি বিজয়ী মুডে আবার চাঙ্গা হয়ে যেতে পারত। সেদিক থেকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি সরকারের জন্য উপযুক্ত 'মধ্যম পন্থা'। খালেদা জিয়ার নাজুক স্বাস্থ্যের চূড়ান্ত অবনতির দায় যেমন নিতে হলো না, তেমনই তার মুক্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপি পুনঃসংগঠিত হওয়ারও সুযোগ পেল না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যেমন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত করেছে, তেমনই সেটাকে কেন্দ্র করে 'শোডাউন' করার সুযোগও সীমিত করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনৈতিক লাভ কি কিছু রয়েছে? আমার মতে, এর মধ্য দিয়ে আসলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেল। এতদিন স্বাভাবিকভাবেই দলটির প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তি। আন্দোলন, নির্বাচন, সংগঠন গোছানো- যে কাজেই হোক, এই এজেন্ডা এক নম্বরে না রেখে উপায় ছিল না বিএনপি নেতৃত্বের। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীর চাপের মুখে হলেও। এমনিতেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ক্ষোভ অনেক। তার ওপর খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি সামনে না রাখলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত না। এখন খালেদা জিয়াকে গুলশানে 'কোয়ারেন্টাইন' রেখে হলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দল গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। তাতে করে বিএনপি আগামী কয়েক বছরে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের মতো শক্তিশালী হতে পারবে, এমন নয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তি সুদূর পরাহত ভেবে ভেবে দলটির সর্বস্তরে যে হতাশার শ্যাওলা জমেছিল, তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
এটা স্পষ্ট, খালেদা জিয়া ছয় মাসের জন্য 'মুক্তি' পেলেও রাজনীতিতে সহসা জড়িত হচ্ছেন না। সেটা কেবল সাজা স্থগিতের শর্তের কারণেও নয়, তার নাজুক স্বাস্থ্য বিবেচনাতেও। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তার নেত্রীকে হাসপাতালের কারা-কেবিন থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বুধবার তা স্পষ্ট জানিয়েছেন। কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও বেগম জিয়া এখন বিএনপির রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবেন। সর্বজনগ্রাহ্য নেতার উপস্থিতিতে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, ফোনের ওপাশে বা দুই কদম দূরত্বে তার উপস্থিতিই তা দূর করতে যথেষ্ট। বিএনপির জন্য সেটাই উনিশ থেকে বিশ প্রাপ্তি। বিএনপিকে ঘিরে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে যারা জোয়ার আনতে চেয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার 'পারিবারিক মুক্তি' সেই জোট নেতাদের স্বপ্ন মাঠে মেরেছে। আওয়ামী লীগের নিরেট লাভ এটাই।
আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণমতে, খালেদা জিয়াকে আর কারাগারে ফিরতে হবে না। শাস্তি স্থগিতের মেয়াদ বরং দফায় দফায় বাড়তে থাকবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি খুব সম্ভবত বিদেশে ছেলে ও নাতি-নাতনির কাছে চলে যাবেন। তার পরিবারও স্বাভাবিকভাবেই বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ এই রাজনীতিককে আর কোনো ধরনের চাপ নিতে দেবে না। চিকিৎসা ও পারিবারিক সান্নিধ্যই তার জন্য যে জরুরি, পরিবারের চেয়ে কে বেশি বুঝবে? এদিকে যত দিন যাবে, পারিবারিক খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই রাজনৈতিক খালেদা-পরবর্তী বিএনপির রূপ ও রেখাগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকবে।
  লেখক ও গবেষক
skrokon@gmail.com