- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- বঁধু মিছে রাগ 'করোনা'
বঁধু মিছে রাগ 'করোনা'

করোনা ক্রান্তিকালে একটি প্রশ্ন মনে ধাক্কা দিয়ে যায়- মানুষ কতটা সহিষুষ্ণ হতে পারে? অনেক খোঁজাখুঁজির পর উত্তর একটি পেয়েছি। তা হলো, মানুষ পরিস্থিতিভেদে সহিষুষ্ণ বা অসহিষুষ্ণ। অসহিষুষ্ণতা ইদানীং বিশ্বজুড়ে বহুচর্চিত শব্দ। শব্দটি সম্প্রতি সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, যা তড়িৎপৃষ্ট করছে আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিকে, বাংলাদেশের সমাজকেও। অথচ গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, অগ্রজ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির, নবী মুহাম্মদ (সা.), যিশুখ্রিষ্ট- সবার জীবনে রয়েছে পরিস্থিতিভেদে সহিষুষ্ণতার দুর্দান্ত সব উদাহরণ। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও জাত-প্রথাবিরোধী মহান পুরুষ চৈতন্য বলছেন, 'তৃণাদপি সুনীচেন তরুরূপি সহিষুষ্ণনা।/অমানীনা মানদেন কীর্তনীয়া সদা হরি।' অর্থ- যিনি নিজেকে সবার পদদলিত তৃণের থেকেও ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষুষ্ণ, যিনি মানশূন্য এবং অন্য সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনি সর্বক্ষণ পারমার্থিক কীর্তনে বিভোর।
অসহিষুষ্ণতা আসলে একটি মানসিক অবস্থান; অন্যের মতকে সহ্য করতে না পারা। বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো, 'অসহিষুষ্ণতার বিষয়ে আমরা বড্ড বেশি সহিষুষ্ণ।' দিনে দিনে যেভাবে অসহিষুষ্ণতা গ্রাস করছে চারপাশকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও প্রকট হওয়া দরকার। এই চরম পন্থার যুগে উদাসীন থাকার অর্থ, অসহিষুষ্ণ পরিবেশের সঙ্গে সমঝোতা করা। চারপাশের অসহিষুষ্ণতাকে বৈধতা দেওয়া। প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়োভস্কি বলেছেন, 'তোমার হৃদয়ের যতটা আমাকে দিতে পার, তার বেশি তো আমি চাইতে পারি না।' করোনাভাইরাসকে আমরা যতটা দিতে পারি, তার চাইতেও সে বেশি নিচ্ছে। সারা পৃথিবী আজ মহামারি প্রত্যক্ষ করছে। পারস্যের কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি বলেছেন, 'তুমি কেবল দৃষ্টির সীমারেখা থেকে চলে গিয়েছ, হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নয় হে প্রিয়; সেখানে তুমি সর্বদা বিরাজমান।' পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। কী এক অদৃশ্য জীবাণুর কাছে সুদৃশ্য পৃথিবী অচল! মক্কা-মদিনা বন্ধ, ভ্যাটিকানে ছুটি, তিরুপতি-বালাজি বন্ধ, বুদ্ধগয়ায় ঢল নেই। খোদার দুনিয়ায় সবাই মুখোশ পরে চলছি। অথচ পৃথিবীর সব হাসপাতাল খোলা। জরুরি বিভাগ খোলা। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ডাক্তার। চিকিৎসাবিজ্ঞান জেগে আছে হাসপাতালে হাসপাতালে।
ভাবতেই অবাক লাগছে, কী এক অদৃশ্য জীবাণু এই সুদৃশ্য পৃথিবী থেকে মানুষকে সংগনিরোধ করে দিল! তবুও আশায় বুক বেঁধে আছি- অদৃশ্য জীবাণুকে পরাজিত করে মানুষ তার জয়রথ অব্যাহত রাখবে। মানুষ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করবে ভয়। ভয় খুব বাজে ব্যাপার। মৃত্যুর আগে মৃত্যুভয় মানুষকে অর্ধমৃত করে ফেলে। এটাই ভয়ের সংস্কৃতি। অথচ সাহস আমাদের পূর্বপ্রস্তুত রাখে; ভয় কেবল আতঙ্কিত আর দুর্বলই করে! এদিকে আতঙ্কিত মানুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশে আরও আতঙ্ক ছড়ায়! আমাদের দেশ ও পৃথিবী এখন ভয়ের সংস্কৃতির রাজ্য! এমন দুঃসময়ে আমাদের সর্বত্র সাহসী-সচেতন-কুসংস্কারহীন নেতৃত্ব প্রয়োজন! আতঙ্ক মানেই কিন্তু এক কিস্তি মৃত্যু! সাহস হচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়ী দাওয়াই!
মহাভারত গ্রন্থে কৃষ্ণ বলছেন অর্জুনকে, 'মানুষের হৃদয়ে ভয়ের সাম্রাজ্য বসত করে সদাই। কখনও সম্পত্তিনাশের ভয়, কখনও অপমানের ভয়, কখনও আপনজনের সঙ্গে বিচ্ছেদের ভয়...। এ জন্য ভয়ের অস্তিত্ব সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। ভয় ধারণ করলে ভবিষ্যতের দুঃখ দূর হয় না। ভয় কেবল আগামী দুঃখের কল্পনা মাত্র।'
'ভয়' আসলে কেউ নয়। ভয় হলো মনের তৈরি একটি মানসিক অবস্থা। খুব অল্প মানুষ ভয়কে জয় করতে পেরেছে এই পৃথিবীতে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করি অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটি উক্তি, 'বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি এখন প্রবল, কিন্তু সেটা চূড়ান্ত নয়। ব্যক্তির সক্রিয়তাই নির্ধারণ করবে ভয়ের সংস্কৃতির পরিণতি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।' পরে আমি বুঝেছি, পৃথিবীর বুকে সব অনাচারের কারণ অসৎ মানুষ। নয় সৎ মানুষের নীরবতা। নীরবতার অপর নাম সুবিধাবাদ। বাংলাদেশেও এখন তিনটি সংস্কৃতি বিদ্যমান। ভয়ের সংস্কৃতি, নীরবতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার সংস্কৃতি। ক্ষমতাবানের ক্ষমতার মুখেও কেউ কেউ নীরবতা ভেঙে ভয়কে মোকাবিলা করতে পারে। প্রত্যাশা থাকল, করোনা ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষ সহনশীলতার পরিচয় দেবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিতে আসবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা মানুষদের আইডেন্টিফাই, কোয়ারেন্টাইন করে না রাখলে অনেক বেশি ছড়াবে এই ভাইরাস। তাই আজ আমরা একে অপরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখছি, যাতে আগামীকাল স্থায়ীভাবে দীর্ঘ সম্পৃক্ত হতে পারি। আজ আমরা পরস্পর হাত মেলাচ্ছি না বলে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি? না। আগামী দিনগুলোতে দীর্ঘ আলিঙ্গনের জন্য আমাদের এই ত্যাগ। সুতরাং রাত শেষে সূর্য উঠবেই। আজ প্রিয়জনকে সাময়িক 'ত্যাগ' মানে আগামী দিনের জন্য চিরস্থায়ী 'ট্যাগ'! করোনার গৃহবন্দিত্ব, আসলে প্রকৃত ভালোবাসা, যা মানুষকে মাঝে-মাঝে দূরে ঠেলে দেয়! তাই আজ গাইতে হবে, 'আমি দূর হতে (তিন ফিট নূ্যনতম) তোমারে দেখেছি...।' কারণ হাত বাড়ানোর সময় এখন নয়। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র বলেছেন, 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।' ভালোবাসা দূরত্ব মানে না। করোনাক্রান্ত সমাজবিচ্ছিন্ন এই সময়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর স্বরে সুর বেজে ওঠে- 'আমার ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে/ আছো তুমি হৃদয়জুড়ে।' সে তুমি যতই গৃহবন্দি থাকো!
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
rajibndy@gmail.com
মন্তব্য করুন