
বিখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের স্বনামধন্য কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ তার 'দ্য বেস্ট কেইস আউটকাম ফর দ্য করোনাভাইরাস অ্যান্ড দ্য ওয়স্ট' শিরোনামের একটি সাম্প্রতিক (২১ মার্চ ২০২০) নিবন্ধে আগামী এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুটি সম্ভাবনার কথা লিখেছেন, যার একটি নেতিবাচক, আরেকটি ইতিবাচক।
নেতিবাচক আশঙ্কাটি হলো- যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষণা মোতাবেক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ২২ লাখ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের শেষকৃত সম্পন্ন হয়েছে কোনো রূপ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। হাসপাতালে স্থান সংকুলানের অভাবে হৃদরোগ, অ্যাজমা ও বহুমূত্র রোগের জটিলতার কারণে আরও অসংখ্য ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। অর্থনীতি মহামন্দায় নিপতিত হয়েছে; কারণ মানুষ বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে; যার ফলে সনাতন ফিসকাল এবং মনিটারি পলিসি আর কাজ করছে না। একটি কার্যকর প্রতিষেধক টিকা আবিস্কার এখনও বহুদূরে, ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষণস্থায়ী এবং বার্ষিক ফ্লুর মতো করোনাভাইরাসের প্রকোপও নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ইতিবাচক দিকটি হলো- ২০২০ সালের গ্রীষ্ফ্মকালের শেষ দিকে মানুষের জীবন স্বাভাবিক এবং অর্থনীতি দারুণভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের বসন্তকালে একটি সংক্ষিপ্ত ও ভয়ংকর ধাক্কা কাটিয়ে ভাইরাস সংক্রমণের প্রক্রিয়াকে ভাঙতে পেরেছে। উষ্ণ আবহাওয়া সংক্রমণের বিস্তার হ্রাস করে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোয় গ্রীষ্ফ্মকালীন সময়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে। শরৎকালে দ্বিতীয় দফা প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে মিউটেশনের কারণে ভাইরাসের ভয়ংকর হ্রাস পেয়েছে, অনেক বেশি মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে এবং বাজারে প্রাপ্ত ওষুধ ভাইরাস চিকিৎসায়, এমনকি এর সংক্রমণে কার্যকারিতা প্রদর্শন করছে। হাজার হাজার অশীতিপর ও অশীতিপর নয় এমন ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে, কারও কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার কারণে। তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা ব্যবহার শুরু হবে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবে।
ক্রিস্টফের চিত্রিত কোন সম্ভাবনাটি সত্য হবে? অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, দুই মাস আগে একই দিনে ২০ জানুয়ারি, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে। এ সময়ের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন করে সংক্রমিত হওয়ার হার শূন্যতে নেমে এসেছে। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণের হার স্থিতিশীল থাকলেও গত কয়েকদিনে মূলত বেশি হারে ভাইরাস শনাক্ত করার কারণে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, যা লক্ষাধিক ব্যক্তিতে উন্নীত হয়েছে। এরই মধ্যে দেড় সহস্রাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে এবং এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারে এমন উল্লম্ম্ফনের কারণ কী? এর কারণ হলো, প্রথম থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট করোনাভাইরাসের হুমকিকে ভুয়া এবং তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন যে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে ২৯ জানুয়ারি উপ-রাষ্ট্রপতি মাইক পেন্সকে প্রধান করে আসন্ন সংকট রোধে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তিনি একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেন। এই টাস্কফোর্স লাইভ টেলিভিশনের সামনে প্রতিদিন ব্রিফিং দিচ্ছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে উপস্থিত থাকছেন। এটি সুস্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মার্কিন প্রশাসনের দায়িত্বহীন আচরণেরই মাশুল গুনছে। পক্ষান্তরে দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম থেকেই করোনাভাইরাসের ঝুঁকিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তারা দ্রুত একটি টেস্ট তৈরি করেছে এবং তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে সংক্রমণের হার ৯০ শতাংশ কমে এসেছে। অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম থেকে দায়িত্বশীল আচরণের সুফলই এখন পাচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া চীন, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফলতা প্রদর্শন করছে। চীন প্রথমদিকে সংক্রমণের ঝুঁকিকে উপেক্ষা এবং এ ব্যাপারে তথ্য গোপন করলেও, পরবর্তী সময়ে এর বিস্তার ঠেকাতে চরম কড়াকড়ির আশ্রয় নেয়। তারা উহান শহরের আক্রান্ত এলাকাকে পুরোপুরি লকডাউন করে। একই সঙ্গে পুরো এলাকা পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপারে আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা চিকিৎসকদের অতি সুরক্ষামূলক পোশাক প্রদান করে। ফলে চীনে পরবর্তী সময়ে কোনো চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। পক্ষান্তরে কম নিরাপদ পোশাক ব্যবহার করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সেবা প্রদানকারী চিকিৎসকরাও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সিঙ্গাপুরও প্রথম থেকেই অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে তাদের সংক্রমণের হারও প্রায় শূন্যতে নেমে এসেছে।
এর বিপরীতে ইতালির কথা ধরা যাক। ইতালি এখন করোনাভাইরাসের এপিসেন্টারে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাস থেকে ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা এখন প্রায় ১৩ হাজারেরও বেশি, যা অনেক আগেই চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত শনিবার একদিনেই সর্বোচ্চ ৭৯৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মূল কারণ হলো- ঝুঁকির মুখেও ইতালিয়ানরা তাদের জীবনযাত্রা প্রণালি পরিবর্তন করতে অনীহা প্রদর্শন করে, যা ছিল এক চরম দায়িত্বহীন আচরণ।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য এশিয়ান দেশ থেকে আমাদের শিক্ষা হলো- সতর্কতা অবলম্বন করা, ঝুঁকি এড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, আগ্রাসীভাবে পরীক্ষা করা, আক্রান্তদের পৃথক করা, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা, সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখা এবং জনগণকে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করা। এর ব্যত্যয় ঘটলেই ইতালির মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য দুটি : সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমানো এবং সংক্রমিত হার বা যে কার্ভ যথাসম্ভব সমতল করা। সংক্রমিত হওয়ার হার কমলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ওপর চাপ কমে যায় এবং মৃত্যুর হার হ্রাস পায়। কারণ হঠাৎ করে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং ভেন্টিলেটর ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে তার জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই যেসব দেশ দ্রুত আগ্রাসী ব্যবস্থা নিয়েছে, তারাই সংক্রমণের এবং একই সঙ্গে মৃত্যুর হার কমাতে পেরেছে। এশিয়ান দেশগুলোর সফলতার পেছনে এ-ই কারণ।
এটি সুস্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের অর্বাচীন তার কারণে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে ত্বরিত গতিতে ব্যবস্থা নিতে অপারগতার ফলে সেখানে সংক্রমণের ও মৃত্যুর হার দ্রুত বাড়ছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক থেকে পৃথিবী সেরা। তাই প্রকৃতি বিরূপ না হলে তাদের পক্ষে আসন্ন মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণ ঘটানো হয়তো সম্ভব হবে, যদিও প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বড় ধরনের মাশুলের বিনিময়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক দরিদ্র দেশ এবং আমাদের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্যও অনেক সীমিত। আমাদের রয়েছে ব্যাপক ঘনবসতি। আরও রয়েছে ভেন্টিলেটরের মতো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রীর অপ্রতুলতা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্বল অবকাঠামো। এ ছাড়া বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী, যারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে ছিলেন, এরই মধ্যে দেশে ফিরে এসে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ছয়জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যদিও এ সংখ্যার সঠিকতা নিয়ে অনেকের মনেই গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পুরো দেশ প্রায় লকডাউন করে ফেলেছে। প্রথমত, সরকার ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। তা সত্ত্বেও আমরা কি সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ এড়াতে পারব?
এ মহাদুর্যোগ এড়াতে হলে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে আমি সবাইকে গ্রামে গ্রামে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। আসুন, আমরা 'সবাই মিলে শপথ করি, করোনাভাইরাসমুক্ত গ্রাম গড়ি'। গ্রাম করোনাভাইরাসমুক্ত করা গেলে সবাই নিরাপদ থাকবে, যার মধ্যে পাড়া-প্রতিবেশীর পাশাপাশি আমার নিজের স্বজনরাও অন্তর্ভুক্ত। কারণ প্রতিবেশীরা আক্রান্ত হলে আমার আপনজনেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আমি নিশ্চিত যে, সারাদেশের সচেতন মানুষ এগিয়ে এলে আমরা গ্রামে গ্রামে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মতো দুর্গ গড়ে তুলতে পারব, যা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাব্রতীরা আমাদের কর্ম এলাকার দেড় সহস্রাধিক গ্রামে এ কাজটি করার ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যাতে 'সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে'র সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করছেন। এ কাজে তারা তাদের নিজেদের একদিনের বেতন প্রদানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষণা পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বাংলাদেশের জন্য আশার বাণী শোনাতে পারেননি, বরং তারা আমাদের জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
মন্তব্য করুন