
করোনা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কতদিন এ পরিস্থিতি থাকবে, তা কেউ জানে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে মুখ খুলছে না। শুধু এটুকু বলছে, আগামী এক বছরের মধ্যে কোনো প্রতিষেধক পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারকরা দাবি করছেন, ম্যালেরিয়া, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি রোগের জন্য প্রচলিত ওষুধ করোনা প্রতিরোধে কাজ করছে। কেউ কেউ শতভাগ সাফল্যের দাবি করেছে। এ বিষয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলার কথা, তারা কেউ কিছু বলছে না। প্রতিষেধক অথবা নিরাময়কারী কোনো ওষুধ না এলে করোনা মহামারি কীভাবে রোধ করা যাবে? শুধু ঘরে বসে থাকা আর সামাজিক সঙ্গরোধ করে কি এই চরম বিস্তার শক্তির অধিকারী না দেখা শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? এমন পরিস্থিতিতে আগামী তিন মাসের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা।
আগামী তিন মাস ঘরে বসে থাকা, সামাজিক সঙ্গরোধ করা কি সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। একটা উত্তর হতে পারে- মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে সারা পৃথিবীকে। নিশ্চিত করে কোনো কিছু ভাবা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এমনই হয় যুদ্ধের সময়ে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ জানে না- কে জিতবে, কে হারবে। আমরা অন্তত এটা জানি, কভিড-১৯ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। সে মানুষের বুদ্ধির কাছে হারবেই। আজ, কাল অথবা পরশু। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা মূলত দুই রণক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি। এই যুদ্ধে একদিকে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি অর্থনীতির চাকাটাও চালু রাখতে হবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ঘরে থাকা; সামাজিক
সঙ্গরোধ করা; আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া; হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নতা কর্মী- সবার দেখভাল করা; এদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা। অন্যদিকে অর্থনীতি চালু রাখা।
করোনাভাইরাসের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা দিচ্ছেন দুনিয়াসেরা অর্থনীতিবিদরা। তারা এমন বলছেন, এই ক্ষতি ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে। গোল্ডম্যান সাকস, জেপি মরগান ও মরগ্যান স্ট্যানলি বলেছেন, বছরের প্রথম তিন মাসে আমেরিকার অর্থনীতি কমবে ৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় তিন মাসে কমবে ২৪ শতাংশ- ৩০ শতাংশ। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভ নুচিন সাবধান করে বলেছেন, বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমেরিকানদের মতো পরিস্থিতি আমাদের হবে না- সেটা নিশ্চিত। তাদের অর্থনীতির তুলনায় আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক। তা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতির ওপর যে বড়সড় চাপ আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিক চাপ দুইভাবে আসবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমবে। দেশের মানুষ কাজ করতে না পারলে দেশজ উৎপাদন কমবে। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে অর্থনীতি আরও খর্বকায় হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উচিত এখনই এই চাপটা কত বড় হবে, কতদিন ধরে চলবে ইত্যাদি নির্ধারণ করতে মাঠে নেমে পড়া। আমাদের এখানে নিয়মিত কতগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। সেগুলো হচ্ছে বেকারত্বের পরিস্থিতি, বিগত তিন মাসের জিডিপি এবং পরবর্তী তিন মাসের জিডিপির পূর্বাভাস ইত্যাদি। এসব তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নিয়মিত সাধারণের কাছে পৌঁছানো দরকার।
যে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। বাংলাদেশ জিডিপিতে কৃষি খাতের ভূমিকা ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ; শিল্প খাতের ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সেবা খাতের ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ। সেবা খাতে মোট কর্মক্ষম জনশক্তির ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ কাজ করে। শিল্পে নিযুক্ত ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা সেবা খাত। চিকিৎসা ছাড়া সব রকমের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। চীনের হুবেইতে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর এখন তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিন মাস পার হলেও এখনও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়নি। মার্চের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে সেখানে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। তারপরও হুবেই খুলে দেওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কবে নাগাদ সেখানে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যাবে, কেউ জানে না। আমাদের এখানে কবে এ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। কৃষি খাতের ওপর করোনা তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।
শিল্পকারখানা চালু রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারখানায় অনেক মানুষকে কম জায়গার মধ্যে একত্র হয়ে কাজ করতে হয়। সেখানে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অবকাশ বেশি। তবে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো কারখানায় মেশিনপত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় পরপর সাজানো থাকে। দুটি যন্ত্রের দূরত্ব তিন ফুটের বেশি হলে আর কারখানাটি এবং কর্মীদের নিয়ম মোতাবেক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে করোনার বিস্তার এড়িয়ে চলা সম্ভব। তবে সব রকম সুরক্ষা নিয়ে কারখানায় শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে রাখা যায় কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। মোট জনশক্তির (১৭ কোটি) ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় ১০ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এই কর্মক্ষম মানুষের ৮৭ শতাংশ বা প্রায় ৮ দশমিক ৭ কোটি মানুষ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এর মধ্যে কৃষি খাতে নিযুক্ত জনশক্তি রয়েছে। মোট কর্মক্ষম মানুষের ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বা ৩ দশমিক ৫ কোটি মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। বাকি প্রায় ৫ দশমিক ২ কোটি মানুষ কাজ করে অকৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, নির্মাণ শিল্প, বাস-ট্রাক-লেগুনা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কাজ নেই। এক বছর বা তিন মাস বা তিন সপ্তাহ ধরে, সে যাই হোক না কেন, বেশিরভাগ মানুষের কাজ থাকবে না। কাজ নেই তো মজুরি নেই। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই নিম্ন আয়ের মানুষ। কাজ না থাকলে এদের আয় থাকবে না। আয় না থাকলে তারা খাবার কিনবে কী করে? বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির খরচ দেবে কীভাবে?
এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চালু রাখতে হবে। অর্থনীতি চালু রাখতে হলে একদিকে কৃষি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে; আরেকদিকে উৎপাদিত পণ্য কেনার চাহিদা বজায় রাখতে হবে। উৎপাদিত পণ্য কেনার জন্য মানুষের হাতে টাকা থাকতে হবে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের কর্মজীবী। এদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। বেশিরভাগ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে; দিন আনে দিন খায়। কিছু কারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শ্রমিক মাস শেষে বেতন পেলেও তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এদের হাতে নগদ টাকা পৌঁছাতে হবে। এদের হাতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে নগদ টাকা পৌঁছাতে হবে। অন্য কোনো মাধ্যমে টাকা পৌঁছাতে গেলে মাঝপথে তা পিঁপড়ায় খাবে।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনাগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে যথেষ্ট মনে হলেও সরকারের দেওয়া প্রণোদনা পরিস্থিতির নিরিখে নিতান্ত কম মনে হয়েছে। সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছে। এ টাকা কারখানার মালিকদের হাতে না দিয়ে তা সরাসরি শ্রমিকদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে যেসব শিল্প ও ব্যবসায় পণ্য ও সেবা জোগান দিয়ে থাকে, তাদের বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ এই খাতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা রপ্তানি খাতের তুলনায় অনেক বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে শুধু রপ্তানি খাত নয়, সব খাতেই বিক্রি কমে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে পারলে তাদের শ্রমিকদের আয়ের জন্য সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ দিতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের শ্রমিকদের আয়ের সংস্থান করতে পারবেন।
শ্রমজীবী মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাতে পারলে অর্থনীতি চালু রাখা সম্ভব হবে। নতুবা পণ্য বাজারে থাকলেও তা কেনার মানুষ থাকবে না। কেনার মানুষ না থাকলে উৎপাদন কমে গিয়ে অর্থনীতি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়বে। আরেকদিকে উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে না পারলে টাকা দিয়েও কাজ হবে না। পণ্যের অভাবে মুদ্রাস্টম্ফীতি আকাশ ছোঁবে। তখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সরকার এই দুর্যোগের সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হবে জনগণকে। তিন মাস ধরে অচলাবস্থা চললে, উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশ দুর্ভিক্ষাবস্থার দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে। তিন মাসের চেয়ে বেশি দিন ধরে বিশ্বব্যাপী অচলাবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হবে তা আর ভাবা যাচ্ছে না।
পরামর্শক ও কলাম লেখক
আগামী তিন মাস ঘরে বসে থাকা, সামাজিক সঙ্গরোধ করা কি সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। একটা উত্তর হতে পারে- মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে সারা পৃথিবীকে। নিশ্চিত করে কোনো কিছু ভাবা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এমনই হয় যুদ্ধের সময়ে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ জানে না- কে জিতবে, কে হারবে। আমরা অন্তত এটা জানি, কভিড-১৯ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। সে মানুষের বুদ্ধির কাছে হারবেই। আজ, কাল অথবা পরশু। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা মূলত দুই রণক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি। এই যুদ্ধে একদিকে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি অর্থনীতির চাকাটাও চালু রাখতে হবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ঘরে থাকা; সামাজিক
সঙ্গরোধ করা; আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া; হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নতা কর্মী- সবার দেখভাল করা; এদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা। অন্যদিকে অর্থনীতি চালু রাখা।
করোনাভাইরাসের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা দিচ্ছেন দুনিয়াসেরা অর্থনীতিবিদরা। তারা এমন বলছেন, এই ক্ষতি ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে। গোল্ডম্যান সাকস, জেপি মরগান ও মরগ্যান স্ট্যানলি বলেছেন, বছরের প্রথম তিন মাসে আমেরিকার অর্থনীতি কমবে ৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় তিন মাসে কমবে ২৪ শতাংশ- ৩০ শতাংশ। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভ নুচিন সাবধান করে বলেছেন, বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমেরিকানদের মতো পরিস্থিতি আমাদের হবে না- সেটা নিশ্চিত। তাদের অর্থনীতির তুলনায় আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক। তা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতির ওপর যে বড়সড় চাপ আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিক চাপ দুইভাবে আসবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমবে। দেশের মানুষ কাজ করতে না পারলে দেশজ উৎপাদন কমবে। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে অর্থনীতি আরও খর্বকায় হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উচিত এখনই এই চাপটা কত বড় হবে, কতদিন ধরে চলবে ইত্যাদি নির্ধারণ করতে মাঠে নেমে পড়া। আমাদের এখানে নিয়মিত কতগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। সেগুলো হচ্ছে বেকারত্বের পরিস্থিতি, বিগত তিন মাসের জিডিপি এবং পরবর্তী তিন মাসের জিডিপির পূর্বাভাস ইত্যাদি। এসব তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নিয়মিত সাধারণের কাছে পৌঁছানো দরকার।
যে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। বাংলাদেশ জিডিপিতে কৃষি খাতের ভূমিকা ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ; শিল্প খাতের ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সেবা খাতের ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ। সেবা খাতে মোট কর্মক্ষম জনশক্তির ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ কাজ করে। শিল্পে নিযুক্ত ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা সেবা খাত। চিকিৎসা ছাড়া সব রকমের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। চীনের হুবেইতে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর এখন তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিন মাস পার হলেও এখনও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়নি। মার্চের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে সেখানে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। তারপরও হুবেই খুলে দেওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কবে নাগাদ সেখানে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যাবে, কেউ জানে না। আমাদের এখানে কবে এ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। কৃষি খাতের ওপর করোনা তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।
শিল্পকারখানা চালু রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারখানায় অনেক মানুষকে কম জায়গার মধ্যে একত্র হয়ে কাজ করতে হয়। সেখানে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অবকাশ বেশি। তবে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো কারখানায় মেশিনপত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় পরপর সাজানো থাকে। দুটি যন্ত্রের দূরত্ব তিন ফুটের বেশি হলে আর কারখানাটি এবং কর্মীদের নিয়ম মোতাবেক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে করোনার বিস্তার এড়িয়ে চলা সম্ভব। তবে সব রকম সুরক্ষা নিয়ে কারখানায় শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে রাখা যায় কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। মোট জনশক্তির (১৭ কোটি) ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় ১০ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এই কর্মক্ষম মানুষের ৮৭ শতাংশ বা প্রায় ৮ দশমিক ৭ কোটি মানুষ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এর মধ্যে কৃষি খাতে নিযুক্ত জনশক্তি রয়েছে। মোট কর্মক্ষম মানুষের ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বা ৩ দশমিক ৫ কোটি মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। বাকি প্রায় ৫ দশমিক ২ কোটি মানুষ কাজ করে অকৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, নির্মাণ শিল্প, বাস-ট্রাক-লেগুনা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কাজ নেই। এক বছর বা তিন মাস বা তিন সপ্তাহ ধরে, সে যাই হোক না কেন, বেশিরভাগ মানুষের কাজ থাকবে না। কাজ নেই তো মজুরি নেই। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই নিম্ন আয়ের মানুষ। কাজ না থাকলে এদের আয় থাকবে না। আয় না থাকলে তারা খাবার কিনবে কী করে? বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির খরচ দেবে কীভাবে?
এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চালু রাখতে হবে। অর্থনীতি চালু রাখতে হলে একদিকে কৃষি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে; আরেকদিকে উৎপাদিত পণ্য কেনার চাহিদা বজায় রাখতে হবে। উৎপাদিত পণ্য কেনার জন্য মানুষের হাতে টাকা থাকতে হবে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের কর্মজীবী। এদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। বেশিরভাগ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে; দিন আনে দিন খায়। কিছু কারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শ্রমিক মাস শেষে বেতন পেলেও তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এদের হাতে নগদ টাকা পৌঁছাতে হবে। এদের হাতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে নগদ টাকা পৌঁছাতে হবে। অন্য কোনো মাধ্যমে টাকা পৌঁছাতে গেলে মাঝপথে তা পিঁপড়ায় খাবে।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনাগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে যথেষ্ট মনে হলেও সরকারের দেওয়া প্রণোদনা পরিস্থিতির নিরিখে নিতান্ত কম মনে হয়েছে। সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছে। এ টাকা কারখানার মালিকদের হাতে না দিয়ে তা সরাসরি শ্রমিকদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে যেসব শিল্প ও ব্যবসায় পণ্য ও সেবা জোগান দিয়ে থাকে, তাদের বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ এই খাতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা রপ্তানি খাতের তুলনায় অনেক বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে শুধু রপ্তানি খাত নয়, সব খাতেই বিক্রি কমে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে পারলে তাদের শ্রমিকদের আয়ের জন্য সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ দিতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের শ্রমিকদের আয়ের সংস্থান করতে পারবেন।
শ্রমজীবী মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাতে পারলে অর্থনীতি চালু রাখা সম্ভব হবে। নতুবা পণ্য বাজারে থাকলেও তা কেনার মানুষ থাকবে না। কেনার মানুষ না থাকলে উৎপাদন কমে গিয়ে অর্থনীতি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়বে। আরেকদিকে উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে না পারলে টাকা দিয়েও কাজ হবে না। পণ্যের অভাবে মুদ্রাস্টম্ফীতি আকাশ ছোঁবে। তখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সরকার এই দুর্যোগের সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হবে জনগণকে। তিন মাস ধরে অচলাবস্থা চললে, উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশ দুর্ভিক্ষাবস্থার দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে। তিন মাসের চেয়ে বেশি দিন ধরে বিশ্বব্যাপী অচলাবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হবে তা আর ভাবা যাচ্ছে না।
পরামর্শক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন