
'যখন থামবে কোলাহল, ঘুমে নিঝুম চারিদিক/আকাশের উজ্জ্বল তারাটা মিটিমিটি করে শুধু জ্বলছে-/বুঝে নিও তোমাকে আমি ভাবছি/ তোমাকে কাছে ডাকছি'- জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার গাওয়া একটি শ্রোতাপ্রিয় গান। ঘরবন্দি হয়ে ইউটিউবে পুরোনো দিনের এ গানটি শুনছিলাম। মনে হলো, সত্যিই তো; সব কোলাহল কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে! গাড়ির হর্নের তীব্র শব্দ কানের পর্দায় কাঁপুনি তুলছে না, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই। শোনা যাচ্ছে না রিকশার টুং-টাং। সদা জেগে থাকা রাজধানী ঢাকা এমন নীরব-নিস্তব্ধ হতে পারে- ক'দিন আগে বোধ করি কারও কল্পনায়ও ছিল না। অথচ আজ তাই দেখতে হচ্ছে স্ব-নয়নে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই রাজধানীকে কার্যত লকডাউন করা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়; দেশের প্রায় সব এলাকাকেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে পরস্পর থেকে।
আমার বাসাটি শাহজাহানপুরের খিলগাঁও বাগিচায় সায়েদাবাদ-মালিবাগ সড়কের পাশে একেবারে রেললাইন ঘেঁষে। ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত সড়ক। সারাদিন ট্রেন যায় অগুনতি। গাড়ির হর্ন আর ট্রেনের হুইসেলে এখন আর সচকিত হই না। অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ যে অভ্যাসের দাস! রাতবিরেতে ঘুমের ব্যাঘাত কারও কারও হলেও আমার তেমন হয় না। চুপে চুপে বলে রাখি, হেলিকপ্টারে ঘুমানোর রেকর্ডও এ ব্যক্তিটির রয়েছে; কিন্তু সে রাস্তা এখন জনশূন্য। বিরান ভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে। কালেভদ্রে দু'একটি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস বা অটোরিকশাকে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে খুব একটা বের হচ্ছে না। অবশ্য ছুটি ঘোষণার পর হাতে দু'দিন সময় পেয়ে রাজধানীবাসীর বিরাট একটি অংশ মূলত যারা শ্রমজীবী, পাড়ি জমিয়েছেন যার যার গ্রামের বাড়িতে।
সরকারের নির্দেশ ছিল, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়। কিন্তু এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও আমরা নির্বিকার থাকতে পারি; চলে যেতে পারি বেড়াতে। সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ আছে ঠিকই। তবে পাড়া-মহল্লায় আসর গুলজার করার লোকের অভাব নেই। খবর নিলাম, আমার এলাকার (মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর)। উপজেলা সদরে প্রশাসনের নির্দেশে দোকানপাট বন্ধ আছে; তবে বটতলার চায়ের দোকানে ধুন্ধুমার আড্ডা চলছেই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এমন অবস্থা শহর-মফস্বলের অনেক জায়গাতেই।
জনগণকে যার যার ঘরে থাকতে বাধ্য করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের টহলের সচিত্র খবরও আমরা দেখেছি। খবর পাওয়া গেছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখলেই রাস্তায় জটলা পাকানো ব্যক্তিরা দ্রুত সরে পড়ছে নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক চিত্র নয়। কেউ কেউ বলছেন, সরকার একদিকে করোনা প্রতিরোধ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে যেমন দেরি করেছে, তেমনি তা কার্যকর করার ক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেনি।
এসব ঘটনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনে আমাদের ব্যর্থতা এবং সচেতনতার অভাব। যে ভয়ংকর মহামারি গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, তা যে আমাদের জন্য কতটা ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, আমরা যেন বুঝতে পারছি না। স্মর্তব্য, বর্তমানে বিপর্যস্ত ইতালির মানুষও প্রথমদিকে এমনই অবজ্ঞা করেছিল করোনাকে। আজ তারা তার খেসারত দিচ্ছে। আমরা কি তেমন কোনো পরিণতির দিকেই নিজেদের নিয়ে যাচ্ছি?
বলা নিষ্প্রয়োজন, করোনার আক্রমণ প্রতিহত করা বা এ রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা আমাদের নিতান্তই অপ্রতুল। তাই 'প্রিভেনশন বেটার দ্যান কিউর'; অর্থাৎ 'নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়'- এ তত্ত্বের অনুসরণই আমাদের রক্ষা করতে পারে। সরকারের ওপর সব দায়দায়িত্ব না চাপিয়ে কিছু কিছু দায়িত্ব আমরা পালন করলে ক্ষতি কী? কয়েকটা দিন নিজেদের সংবরণ করে রাখলে যদি নিজের ও আশপাশের মানুষের ভালো হয়, তাতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়।
যা হোক, ফিরে আসি গোড়ার কথায়। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার এমন নিস্তব্ধ পরিবেশ আরেকবার দেখা গিয়েছিল ১৯৭১ সালে। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ২৫ মার্চের কালরাতে হাজার হাজার বাঙালি নিহত হয়েছিল। তখনও ছিল চৈত্র মাস। খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের সে দুপুরে আমরা কামানের আওয়াজ শুনছিলাম গ্রামে বসেই। পরে ঢাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে হেঁটে চলে আসা ভীত-সন্ত্রস্ত লোকদের মুখে শুনেছিলাম সেই ভয়ংকর বর্ণনা। একটি কলরবমুখর শহরকে কী নিষ্ঠুরতায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল হিংস্র হানাদার বাহিনী! সেদিন কারফিউ জারি করা হয়েছিল ঢাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারানোর ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে পরের বছর থেকেই ২৬ মার্চ আমাদের জন্য পরিণত হয় আনন্দের দিনে। আমাদের স্বাধীনতা দিবস! একাত্তরে আমরা রক্ত-মাংসের শত্রু সৈন্যদের মোকাবিলা করেছি দৃঢ় মনোবল আর অস্ত্র দিয়ে। এবার এক অশরীরী আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর সে শত্রুকে মোকাবিলা করার প্রধান অস্ত্র সচেতনতা ও সাবধানতা।
অনেক সময় আমরা কোলাহলে বিরক্ত হই। কিন্তু কোলাহল যে কত বড় নেয়ামত, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। নিত্যদিনের ঢাকার সঙ্গে আজকের ঢাকার চেহারার পার্থক্য আমাদের ভারাক্রান্ত করে সঙ্গত কারণেই। এ নীরবতা আমরা চাই না। আমরা চাই কোলাহলপূর্ণ শান্তি ও স্বস্তিদায়ক জীবন। সব সংকট কাটিয়ে আবার সে কোলাহলময় পরিবেশ ফিরে আসুক আমাদের জীবনে- এ মুহূর্তে প্রত্যাশা সেটাই।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
আমার বাসাটি শাহজাহানপুরের খিলগাঁও বাগিচায় সায়েদাবাদ-মালিবাগ সড়কের পাশে একেবারে রেললাইন ঘেঁষে। ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত সড়ক। সারাদিন ট্রেন যায় অগুনতি। গাড়ির হর্ন আর ট্রেনের হুইসেলে এখন আর সচকিত হই না। অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ যে অভ্যাসের দাস! রাতবিরেতে ঘুমের ব্যাঘাত কারও কারও হলেও আমার তেমন হয় না। চুপে চুপে বলে রাখি, হেলিকপ্টারে ঘুমানোর রেকর্ডও এ ব্যক্তিটির রয়েছে; কিন্তু সে রাস্তা এখন জনশূন্য। বিরান ভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে। কালেভদ্রে দু'একটি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস বা অটোরিকশাকে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে খুব একটা বের হচ্ছে না। অবশ্য ছুটি ঘোষণার পর হাতে দু'দিন সময় পেয়ে রাজধানীবাসীর বিরাট একটি অংশ মূলত যারা শ্রমজীবী, পাড়ি জমিয়েছেন যার যার গ্রামের বাড়িতে।
সরকারের নির্দেশ ছিল, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়। কিন্তু এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও আমরা নির্বিকার থাকতে পারি; চলে যেতে পারি বেড়াতে। সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ আছে ঠিকই। তবে পাড়া-মহল্লায় আসর গুলজার করার লোকের অভাব নেই। খবর নিলাম, আমার এলাকার (মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর)। উপজেলা সদরে প্রশাসনের নির্দেশে দোকানপাট বন্ধ আছে; তবে বটতলার চায়ের দোকানে ধুন্ধুমার আড্ডা চলছেই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এমন অবস্থা শহর-মফস্বলের অনেক জায়গাতেই।
জনগণকে যার যার ঘরে থাকতে বাধ্য করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের টহলের সচিত্র খবরও আমরা দেখেছি। খবর পাওয়া গেছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখলেই রাস্তায় জটলা পাকানো ব্যক্তিরা দ্রুত সরে পড়ছে নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক চিত্র নয়। কেউ কেউ বলছেন, সরকার একদিকে করোনা প্রতিরোধ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে যেমন দেরি করেছে, তেমনি তা কার্যকর করার ক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেনি।
এসব ঘটনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনে আমাদের ব্যর্থতা এবং সচেতনতার অভাব। যে ভয়ংকর মহামারি গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, তা যে আমাদের জন্য কতটা ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, আমরা যেন বুঝতে পারছি না। স্মর্তব্য, বর্তমানে বিপর্যস্ত ইতালির মানুষও প্রথমদিকে এমনই অবজ্ঞা করেছিল করোনাকে। আজ তারা তার খেসারত দিচ্ছে। আমরা কি তেমন কোনো পরিণতির দিকেই নিজেদের নিয়ে যাচ্ছি?
বলা নিষ্প্রয়োজন, করোনার আক্রমণ প্রতিহত করা বা এ রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা আমাদের নিতান্তই অপ্রতুল। তাই 'প্রিভেনশন বেটার দ্যান কিউর'; অর্থাৎ 'নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়'- এ তত্ত্বের অনুসরণই আমাদের রক্ষা করতে পারে। সরকারের ওপর সব দায়দায়িত্ব না চাপিয়ে কিছু কিছু দায়িত্ব আমরা পালন করলে ক্ষতি কী? কয়েকটা দিন নিজেদের সংবরণ করে রাখলে যদি নিজের ও আশপাশের মানুষের ভালো হয়, তাতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়।
যা হোক, ফিরে আসি গোড়ার কথায়। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার এমন নিস্তব্ধ পরিবেশ আরেকবার দেখা গিয়েছিল ১৯৭১ সালে। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ২৫ মার্চের কালরাতে হাজার হাজার বাঙালি নিহত হয়েছিল। তখনও ছিল চৈত্র মাস। খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের সে দুপুরে আমরা কামানের আওয়াজ শুনছিলাম গ্রামে বসেই। পরে ঢাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে হেঁটে চলে আসা ভীত-সন্ত্রস্ত লোকদের মুখে শুনেছিলাম সেই ভয়ংকর বর্ণনা। একটি কলরবমুখর শহরকে কী নিষ্ঠুরতায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল হিংস্র হানাদার বাহিনী! সেদিন কারফিউ জারি করা হয়েছিল ঢাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারানোর ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে পরের বছর থেকেই ২৬ মার্চ আমাদের জন্য পরিণত হয় আনন্দের দিনে। আমাদের স্বাধীনতা দিবস! একাত্তরে আমরা রক্ত-মাংসের শত্রু সৈন্যদের মোকাবিলা করেছি দৃঢ় মনোবল আর অস্ত্র দিয়ে। এবার এক অশরীরী আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর সে শত্রুকে মোকাবিলা করার প্রধান অস্ত্র সচেতনতা ও সাবধানতা।
অনেক সময় আমরা কোলাহলে বিরক্ত হই। কিন্তু কোলাহল যে কত বড় নেয়ামত, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। নিত্যদিনের ঢাকার সঙ্গে আজকের ঢাকার চেহারার পার্থক্য আমাদের ভারাক্রান্ত করে সঙ্গত কারণেই। এ নীরবতা আমরা চাই না। আমরা চাই কোলাহলপূর্ণ শান্তি ও স্বস্তিদায়ক জীবন। সব সংকট কাটিয়ে আবার সে কোলাহলময় পরিবেশ ফিরে আসুক আমাদের জীবনে- এ মুহূর্তে প্রত্যাশা সেটাই।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন