নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবারই সহায়তা লাগবে। অমর্ত্য সেন তার দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নিতে হয়, কোন পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ হয় না, সেটা তার বইসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশের আলোচনায় বহুবার বলেছেন। আমেরিকার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি বলতে গিয়ে বলেছেন, কী রকম অবহেলা-উপেক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমে বলেছিলেন, এটা সামান্য সর্দি-কাশি; যেমন বলেছিলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। কিন্তু এখন ট্রাম্প বলছেন, সামনে ভয়াবহ সংকট অপেক্ষা করছে। আগামী কয়েক মাসে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
এই অবস্থার কারণ, করোনাভাইরাস কেবল দেশে-বিশ্বে স্বাস্থ্য সংকটই সৃষ্টি করেনি, প্রচণ্ড অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটও সৃষ্টি করেছে। আইএমএফ ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বিশ্ব মন্দা শুরু হয়ে গেছে। আর এই মন্দাটি হবে অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক। ১৯২৯-৩০-এর মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও করোনাভাইরাস সংকট সৃষ্টি করেছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর প্রধান উপায় হিসেবে 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে বারবার। এখন কেবল সামাজিক দূরত্বই নয়, দৈহিক দূরত্বই বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন, তেমনি অন্যান্য দেশে শপিংমল, দোকান, বাজারে নির্দিষ্ট চিহ্ন এঁকে দিয়ে সে রকম দূরত্বে দাঁড়িয়ে মানুষকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বলা হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত মৃতদের দাফন-কাফনের ক্ষেত্রেও যে নিয়ম অনুসরণ করতে হচ্ছে, তাতে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা নিজেরা উপস্থিত থেকে তাকে বিদায় দিতে পারছেন না। পাড়া-প্রতিবেশীরা তো বটেই। ভারতের উত্তর প্রদেশে করোনা নয়, যক্ষ্ণায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির লাশ সৎকারে স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশী কাউকে না পেয়ে তার চার মেয়েকে লাশ বহন করার চিত্র সামাজিক মাধ্যমে 'ভাইরাল' হয়েছে। 'লকডাউন' পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি মানুষের মধ্যেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে; যাকে করোনা মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে একইভাবে মোকাবিলা করতে হবে। অবশ্য মানুষই আবার এ ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করতে এগিয়ে আসছে।
এসব মানুষকে নিয়েই করোনা মোকাবিলা করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই। আর এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। তারা পাবলিক ওপিনিয়ন লিডার। তারা যদি করোনা মোকাবিলায় সংযুক্ত না হন, তাদের সম্পৃক্ত করা না হয়, তবে মানুষ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। 'কর্তৃত্ববাদী' দেশ বলে অভিহিত চীনের কথাই ধরা যাক। তারা তার নিজ দেশের পার্টির সর্বস্তরকে নামিয়ে দিয়েছিল জনগণকে সচেতন করতে। পার্টির কর্মীরা ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারা সেখানেই থেমে থাকেননি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগ ৩০০ সদস্যের এশিয়ান পলিটিক্যাল পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অনলাইন কনফারেন্সে করোনা প্রতিরোধে সব দেশের রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কম নয়। নির্বাচন কমিশনেই নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দল। তাদের নেতাকর্মীরা যদি করোনা প্রতিরোধে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতেন বা করা যেত, তাহলে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন উপযুক্ত পরামর্শ পাওয়া যেত, তেমনি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত মানুষকে সচেতন করা যেত। সরকার যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যেত। তবে সামরিক শাসনের আমল থেকে যে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চলছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। গত নির্বাচনের পর এটা আরও প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো এর বাইরে নয়। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে লকডাউনে কর্মহীন মানুষের খাবার পৌঁছানো, সবটাই থাকছে বেসামরিক প্রশাসনের হাতে। ২৬ মার্চের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বা লকডাউন বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত করা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। কিন্তু এ ধরনের কোনো কার্যক্রমে এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি কেউই সংযুক্ত নন। রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে তা নিজের থেকে এবং যৎসামান্যই। এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় নিজের উদ্যোগে নির্বাচকমণ্ডলীকে সন্তুষ্ট রাখতে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। কিন্তু সামগ্রিক এই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনুপস্থিত। কেন্দ্রে কেবল প্রধানমন্ত্রী তার সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে আছেন। স্বাস্থ্য, অর্থ, কিছুটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাদে বাকিরা যেন অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েছেন। বিএনপির যেমন সেই রাজনৈতিক শক্তি নেই, তেমনি নেই কোনো উদ্যোগ। কেবল সরকারের সমালোচনা ছাড়া। তাও মৃদু। ১৪ দলের কয়েকটি দল এ ক্ষেত্রে তাদের মতামত দেওয়া ও মানুষকে সহায়তা করার চেষ্টা করছে। ১৪ দলের সমন্বয়ক কোনোভাবে সবাইকে নিয়ে আছেন। বাম জোটও তাদের অস্তিত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার জানান দিচ্ছে। বস্তুত করোনাভাইরাস অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও খরার সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু অমর্ত্য সেনের কথায় করোনা প্রতিরোধে সবার যে সহায়তা লাগবে, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে লাগবে কার্যকরী উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে তৃণমূলের সঙ্গে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক, সামনে যেখানে নির্বাচনের ইস্যু রয়েছে এবং তাতে কে কত মাইলেজ নিতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেখানেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেবল একবার নয়, দু'দফায় সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যেখানে সিএএ ও এনআরসি প্রশ্নসহ দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে বিরোধী দল কংগ্রেস ও তার সাথি দলগুলোর বিরোধ তুঙ্গে, তখন তিনি ৮ এপ্রিল সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেই ক্ষান্ত হননি, ওই বৈঠক যাতে কার্যকর হয় তার জন্য প্রণব মুখার্জি, সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিংসহ বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।
আমেরিকাতেও যে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে অভিশংসনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, তারা রিপাবলিকানদের সঙ্গে মিলে করোনা মোকাবিলায় কয়েক ট্রিলিয়ন আর্থিক বরাদ্দ অনুমোদন করেছে কংগ্রেসে। যুক্তরাজ্যে বরিস জনসনও বিরোধী লেবার পার্টিকে তার করোনা প্রতিরোধ প্রয়াসে যুক্ত করছেন। সেখানে বাংলাদেশের মতো রাজনীতিপ্রবণ এ দেশে এই প্রয়াসে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত না করা কতখানি যুক্তিসঙ্গত, সে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। বরং উল্টো যেটা দেখা যাচ্ছে তা হলো, প্রধান দুই দলের মধ্যে সেই পুরোনো ব্লেম গেমের খেলা।
যেটা এখানে বলা প্রয়োজন যে, করোনাবিরোধী এই লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু প্রধানমন্ত্রী। তিনি কতখানি ও কার কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছেন অথবা কতখানি তাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে, তার নির্দেশ কতখানি বাস্তবায়ন আর কতখানি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছে, সেটা বলা মুশকিল। আবার কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তারপরও প্রধানমন্ত্রীকে তার এই নেতৃত্বদানে রাজনৈতিক দলগুলো তা সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত বা বিরোধী দলই হোক- রাজনৈতিক দলগুলোই উপযুক্তভাবে সহায়তা করতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধানমন্ত্রীকে তার নেতৃত্বে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে বলেছে। এ ধরনের বৈঠক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্যতা বুঝতে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সামাজিক সংগঠনগুলোকে সাহায্য করবে। উপযাচকের ভূমিকা নয়, করোনা লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো ও জনগণকে এ কাজে সমবেত (মোবিলাইজ) করতে সাহায্য করবে।
সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি