দুঃখের দিনে লেখনীরে বলি, লজ্জা দিও না। চলে গেলেন বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা রাখী দাশ পুরকায়স্থ। সম্পর্কে আমরা মাসি- বোনঝি; সিলেটের বিখ্যাত 'পুরকায়স্থ্থ্থ' পরিবারের দুই প্রজন্মের প্রতিনিধি। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও এমন করে বিনা নোটিশে দেশের বাইরে তাঁর জীবনাবসানে আমি শোকে বাকরুদ্ধ।

আমার মা গবেষক ও লেখক ড. নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ ও রাখী মাসি পিঠাপিঠি দুই বোন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে রাখী মাসিই ছিলেন আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয়। আমার ডাক নাম 'সোমা' রাখী মাসিরই দেওয়া। ছোটবেলায় আমাকে মাসি ও পঙ্কজ মেশোর জিম্মায় রেখে আমার মা গুজরাটে ডক্টরেট করতে চলে যান। আমার সাংবাদিক বাবা কিংবা কর্মজীবী রাখী মাসির পক্ষে আমার সার্বক্ষণিক দেখভাল করা সম্ভব ছিল না বলে আমাকে কিছুদিন পর ভর্তি করে দেওয়া হয় ভারতেশ্বরী হোমসে। ভর্তি পরীক্ষার দিন থেকে শুরু করে ভর্তির দিন; এমনকি দুই মাস অন্তর ভিজিটিং ডেতেও রাখী মাসি আমার বাবার সঙ্গে আমাকে নিয়মিত দেখতে হাজির হতেন। ভর্তির আগের দিন বাবা নিজে মনভোলা বলে রাখী মাসির কাছে ভর্তির টাকা রাখতে দিয়েছিলেন। ভর্তির জন্য আমরা সাতসকালে বাসে মির্জাপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। মাঝপথে গিয়ে মাসির খেয়াল হলো, টাকাটা তাঁর কাঁঠালবাগানের বাড়িতেই রয়ে গেছে। ৩০ বছর আগে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে টাঙ্গাইল যাতায়াত করা আজকের মতো এত সহজ ছিল না। যাতায়াত ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। কিন্তু চিরকাল দুরন্ত ও সাহসী রাখী মাসি সব বাধাবিপত্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সোজা মাঝপথে বাস থামিয়ে নেমে গেলেন। উল্টো দিক থেকে আসা লোকে লোকারণ্য এক যাত্রীবোঝাই বাসে কোনোমতে উঠে পড়লেন। এর পর বাড়ি ফিরে গিয়ে টাকাটা নিয়ে ভারতেশ্বরী হোমসের অফিস রুমে হাজির হলে আমার ভর্তি প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে, মাসিসহ আমরা সবাই অভুক্ত। আমার স্মৃতির ক্যানভাসে এখনও উজ্জ্বল সেসব দিন। গরমের ছুটিতে রাখী মাসির কাছেই থাকতাম। সারাদিন চাকরি, রাজনীতি আর সংসার সামলাতেই তার রাত ১২টা বেজে যেত। আশির দশকের গোড়ায় আমার আইনজীবী দাদু আকস্মিকভাবে আততায়ীদের হাতে প্রাণ হারান। ঘটনার ভয়াবহতায় গোটা 'পুরকায়স্থ' পরিবার তখন হতবিহ্বল ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। পারিবারিক জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটার সেই দিনগুলোয় রাখী মাসি ও পঙ্কজ মেশো যেভাবে বটবৃক্ষের মতো গোটা 'পুরকায়স্থ' পরিবারকে ছায়া দিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য। শুধু পারিবারিক জীবনে নয়, খুব ছোটবেলা থেকে দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গেও রাখী মাসিকে আমি বরাবর যুক্ত হতে দেখে এসেছি। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার দৃপ্ত পদচারণার কথা সর্বজনবিদিত।

এই লেখা যখন তৈরি করছি, তখন ভারতের আসামে মাসির মরদেহ দাহ করার কাজে পঙ্কজ মেশো ব্যস্ত। পেশাগত কাজে আমিও এই মুহূর্তে ভারতের অন্য প্রান্তে আছি। কিন্তু করোনাজনিত কারণে ঘোষিত লকডাউনের কারণে একই দেশে থাকা সত্ত্বেও মাসির শেষকৃত্যে শামিল হতে পারিনি। একটা ফুলও দিতে পারিনি! সবার সুখে-দুঃখে যিনি বুক পেতে দেন, আমার সেই বর্ষীয়ান মানবদরদি রাজনীতিবিদ মেশোর জীবনের সবচেয়ে সংকটতম সময়ে তাঁর পাশে থাকতে পারিনি! এই দুঃখবোধ অবশিষ্ট জীবনে আমাকে নিদারুণ কষ্ট দেবে, তা নিশ্চিতভাবে জানি। তবে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলেও মানসিকভাবে নিশ্চয়ই আছি পরিবারের সবার পাশে, বিশেষ করে পঙ্কজ মেশোর পাশে। অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে ভালো থেকো মাসিমণি!

প্রয়াত রাখী দাশ পুরকায়স্থের বড় বোনের মেয়ে; সংবাদ ও উন্নয়নকর্মী