
বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যজয়ের লড়াইয়ে নিয়োজিত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় এক হাজার ১৪৬ জন মানুষ বসবাস করেন। এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ কৃষি এবং শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত। এ দেশের কৃষি ব্যবস্থার এক ধরনের চিরাচরিত নিজস্বতা থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এ ব্যবস্থা এখন এক আশাজাগানিয়া সমৃদ্ধির স্তরে উঠে এসেছে। ধান, গম, ভুট্টা ও আলুর মতো প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে সাফল্যের পাশাপাশি সবজি, ফলমূল ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে ডাল ও তেল বীজ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করছে। পাশাপাশি মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির দ্বারা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আক্রান্ত হওয়া মানে বাঁচা-মরার আরেক সংকটের মুখোমুখি হওয়া। এ কারণে কৃষির ওপর করোনা পরিস্থিতির প্রভাব সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ বা উত্তরণের জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই। কেননা, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ইতোমধ্যে করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতির হালহকিকত সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।
বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন ব্যবস্থায় অক্টোবর মাস থেকে পরের বছর মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় রবি মৌসুম। এ মৌসুম মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য প্রধান মৌসুম। এ মৌসুমে প্রাকৃতিক বৈরিতা তেমন থাকে না। সে কারণে ফসল উৎপাদন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন হয়। এ মৌসুমে প্রধান খাদ্যশস্য বোরো ধানের পাশাপাশি গম, ভুট্টা, আলু, ডাল ও তেল বীজ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচের মতো প্রধান প্রধান মসলা উৎপাদন ও সংগ্রহের কাজ চলে; প্রতিটি কৃষক পরিবার কাটায় ব্যস্ত সময়। এমন একটি সময়ে যদি কৃষকদের ঘরে থাকতে হয়, উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয় না করতে পারে, মাঠের ফসলের যদি প্রয়োজনীয় পরিচর্যা না হলে এর প্রভাব কৃষির ওপর পড়বে বই কি। এ ছাড়া সমাগত খরিপ-১ মৌসুমে আউশ ধান, পাট, মুগ ডাল ইত্যাদি ফসল চাষের প্রস্তুতি ও পরিচর্যা, মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসজুড়ে বোরো ধান কর্তন ও সংগ্রহের কাজে প্রতিনিয়ত কৃষকদের মাঠে যেতে হবে। এপ্রিলের ১৫ তারিখের পর থেকেই হাওরাঞ্চলে শুরু হবে বোরো ধান কর্তন। এ সময় উত্তরবঙ্গের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট এবং জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে কৃষি শ্রমিক হাওরাঞ্চলে যাতায়ত করবেন। প্রয়োজন হবে ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার প্রদত্ত কর্তন যন্ত্র ব্যবহারের। করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব কার্যক্রম যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তার ফল নিশ্চয় কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষিতে যে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহূত হয়, এসব রাসায়নিক দ্রব্যের কোনো কোনোটি কাঁচামাল হিসেবে আবার কোনোটি তৈরি পণ্য হিসেবে বিদেশ থেকে আসে। আমরা যে সবজি, ভুট্টা ও পাট উৎপাদন করি এসব ফসলের বীজের প্রধান উৎস বিদেশ। আলু ও কিছু কিছু হাইব্রিড ধানের বীজও বিদেশ থেকে আসে। পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতির সিংহভাগ আসে বিদেশ থেকে। করোনাজনিত কারণে এসব পণ্য বিদেশ থেকে সময়মতো আসা বিঘ্নিত হলে তার নেতিবাচক প্রভাব কৃষির ওপর পড়তে বাধ্য।
এই যুদ্ধের প্রধান সৈনিক কৃষক ভাইদের পাশে সর্বোচ্চ এবং সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়ে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে; সবার আগে করোনা থেকে এদের রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কৃষক ভাইয়েরা করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যেন শামিল থাকেন, সে জন্য সরকার স্বাস্থ্য বিভাগ ও তথ্য বিভাগের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষক নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রসারণ কর্মীরা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে দ্বিগুণ সতর্কতা, দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে যাতে মাঠ পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তি ও পরামর্শ সেবা অব্যাহত রাখেন, সে জন্য সংস্থা পর্যায়ে এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের জন্য মোবাইল ভাতা বাড়িয়ে এই সেবার পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নিতে হবে। প্রধান কাজ হবে উৎপাদনে কৃষকের মনোবল সুদৃঢ় করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। বিদ্যমান মাঠ ফসলের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা অব্যাহত রাখা; কৃষক ভাইয়েরা স্বউদ্যোগেই এ কাজটি করে থাকেন। আমাদের সম্প্রসারণ কর্মীরা এ কাজে পরামর্শ সেবা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত আছেন। প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, বালাইনাশক, সেচ ব্যবস্থাপনাসহ কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক সময়ে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। রাজস্ব খাতের প্রণোদনা এবং বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম যাতে মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করা। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কৃষিপণ্যের পরিবহন, গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ কাজগুলো নির্বিঘ্ন হয় সে ব্যবস্থা করা। ভর্তুকি মূল্যে প্রদত্ত ধান কাটা যন্ত্রসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ১২ এপ্রিলের মধ্যে হাওরাঞ্চলের কৃষকের মধ্যে পৌঁছানো নিশ্চিত করা।
পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হলে অন্য সব ব্যবস্থার মতো কৃষি খাতের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া কৃষি উপকরণের ওপর বিদেশ নির্ভরতা আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে পারে। অধিকন্তু তৈরি পোশাক রপ্তানি ও জনশক্তি থেকে আয় কমে গেলে তা আমাদের সার্বিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রীয় সামর্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। এমন চরম খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমরা কী পর্যায়ে কৃষি উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখব তথা খাদ্যোৎপাদন চাহিদার সমানুপাতে রাখব, সে বিষয়টি এখন থেকেই ভাবতে হবে।
এপিএ এক্সপার্ট পুল সদস্য, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মন্তব্য করুন