- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- ক্রেডিট ইউনিয়ন সচল থাকুক
ক্রেডিট ইউনিয়ন সচল থাকুক

করোনাভাইরাসজনিত কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সব শ্রেণির লোকই এই বিপর্যয়ের মধ্যে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বল্প আয়ের লোকেরা, স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তারা এবং বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা বিভিন্নভাবে জড়িত তারা। এ শ্রেণির লোকদের জন্য করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন বিদগ্ধজন অনেক মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছেন। এসব পরামর্শ গভীরভাবে বিশ্নেষণ করে আগেভাগেই করণীয় সম্পর্কে ধারণা নিয়ে রাখা যেতে পারে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাকা এখনই কিছুটা সচল রাখতে এবং করোনা-পরবর্তী আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে সমবায়ের মতো পরীক্ষিত ব্যবস্থাটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
আমরা জানি- ১. একক প্রচেষ্টার চেয়ে একই উদ্দেশ্যে সংগঠিত যৌথ প্রচেষ্টাই উত্তম; ২. একক তহবিলের চেয়ে যৌথ তহবিল অনেক বেশি কার্যকর। আর যদি সেই তহবিল নিজেদের সঞ্চিত অর্থে গঠিত হয় তা হলে, এর কার্যকারিতা আরও বেশি; ৩. গণতান্ত্রিক উপায়ে গৃহীত যৌথ সিদ্ধান্ত উত্তম; ৪. যৌথ উদ্যোগ কার্যকর ও টেকসই বেশি; ৫. কোনো বডির কাছে দায়বদ্ধতার স্বচ্ছতা বেশি; ৬. কোনো কমিটির কাছে স্বচ্ছতা প্রমাণ করার সঠিকতা বেশি; ৭. যৌথ উদ্যোগের ইতিবাচক অভিঘাত অনেক বেশি; ৮. যৌথভাবে ঝুঁকি ও দায়দায়িত্ব বহনের ক্ষমতা বেশি; ৯. যৌথ উদ্যোগে কর্মসৃজনের সংখ্যা বেশি এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক এবং ১০. যৌথ উদ্যোগে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহভাগিতা অনেক বেশি।
উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সমবায় ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষি, মৎস্য, কুটির শিল্প, এসএমই খাতে সমবায় ব্যবস্থা বেশি কার্যকর। সমবায় ব্যবস্থার সংগঠিত রূপটি আসলে সরকারের সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত ও নিয়ন্ত্রিত।
বাংলাদেশে মোট ২৯ শ্রেণির সমবায় সমিতি রয়েছে। এর মধ্যে ক্রেডিট ইউনিয়ন হচ্ছে বিশেষ বিশেষায়িত এক শ্রেণির সমবায় সমিতি। উপরোল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সবই ক্রেডিট ইউনিয়ন ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া যায় বিধায় এসব ক্ষেত্রে লুটপাট বা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। ১৯৫৫ সাল থেকে জার্মানির অনুসরণে বাংলাদেশে ক্রেডিট আন্দোলন শুরু হয়। বর্তমানে ক্রেডিট ইউনিয়নের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৪৬টি, ব্যক্তি সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ এবং সমন্বিত মূলধনের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ মূলধন সম্পূর্ণটাই সদস্যদের নিজেদের শেয়ার ও সঞ্চয়ের পুঞ্জীভূত তহবিল। সমবায় সমিতি নীতিমালা অনুযায়ী ক্রেডিট ইউনিয়নের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে- সদস্যদের যৌথ সঞ্চয়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট তহবিল পুনরায় ঋণ (পুঁজি) ও সেবা আকারে উপযুক্ত সদস্যদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা।
করোনাজনিত সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য খাত ও উপখাতের মতো ক্রেডিট ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডেও স্বাভাবিকভাবে ভাটা পড়েছে। নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের তহবিলে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের নিমিত্ত গঠিত ক্রেডিট ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত অর্থনীতির স্বার্থেই সচল রাখা জরুরি। সরকারও অর্থনীতি বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য অন্য বিষয়াদির সঙ্গে এ খাত সংশ্নিষ্ট কিছু নির্দেশনা জারি করেছে এবং হয়তো আরও কিছু করা হবে। এসব নির্দেশনার আলোকে স্বাস্থ্য সুরক্ষাজনিত বিধি মেনেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অদৃশ্যমান খাতের এসব ক্রেডিট ইউনিয়নের কার্যক্রম পূর্ববত অব্যাহত রাখার জন্য নিল্ফেম্নালিখিত উদ্যোগগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে :১. কালবিলম্ব না করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমবায় অধিদপ্তর প্রচার ও মটিভেশনাল নির্দেশনা জারি করতে পারে; ২. ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্যদের অর্জিত নিট মুনাফার ওপর ২০১৫ অর্থবছর থেকে আরোপিত ১৫ শতাংশ কর গ্রহণ স্থগিত করা যেতে পারে; ৩. সম্প্রীতির মতো প্রতিষ্ঠিত ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোকে দেশব্যাপী শাখা খুলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি ও প্রসারিত করার সুযোগ পুনরায় প্রদান করা যেতে পারে; ৪. তহবিল বৃদ্ধির জন্য একটা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে এবং ইতোমধ্যে ঘোষিত প্যাকেজগুলো থেকে কী কী সুবিধা ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্যরাও ভোগ করতে পারে, সে ব্যাপারে সমবায় অধিদপ্তর নির্দেশনা দিতে পারে; ৫. ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্যরা তাদের সমিতি থেকে পুঁজি নিয়ে যেসব অর্থনৈতিক কাজে বিনিয়োগ করে, সেগুলো সচল রাখার জন্য কাজগুলো যাতে অযাচিত ঝুটঝামেলার মধ্যে না পড়ে, সে জন্য সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলো দিয়ে প্রটেক্টেড করা যায়।
সরকারের সাবেক সচিব এবং সমবায় নিবন্ধক
humayunkhalid57@gmail.com
মন্তব্য করুন