আমরা যুদ্ধে ব্যস্ত কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে। এ মুহূর্তে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এত দুশ্চিন্তার প্রয়োজন আছে কি? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। কারণ সার্বিক সুস্থতা মানেই শরীর ও মন দুয়েরই সুস্থতা। শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক। আসলে মানসিক স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির চিন্তাচেতনা, আবেগ-অনুভূতির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়; যার ফলে ওই ব্যক্তি তার ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদন করার ক্ষমতা লাভ করেন এবং অপরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারেন। সুতরাং মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে আমরা এই যুদ্ধে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে স্বীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব কীভাবে? আমরা যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকি, তাহলে এই দুর্যোগময় মুহূর্তে প্রতি পদে পদে যে মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছি, তার সঙ্গে পেরে উঠব কী করে? আমরা তো অল্প চাপেই ভেঙে পড়ব। মূলত মানসিক চাপ শরীর অভ্যন্তরের স্থিতি অবস্থাকে ব্যাহত করে; ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। আমরা জানি, কভিড-১৯-এর কোনো প্রতিষেধক নেই; নেই কোনো কার্যকরী ওষুধ। এই যুদ্ধে তাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র হলো, নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এটি যার যত বেশি থাকবে, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। সুতরাং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ঠিক রাখার জন্য শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবে সুস্থ থাকা একান্ত প্রয়োজন।

এখন এ অবস্থায় আমাদের করণীয়টা কী? আসলে জীবন মানেই তো যুদ্ধ। মাঝেমধ্যেই আমাদের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভীত না হয়ে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ সময় আমরা কে কতটা চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখি, কতটা শান্ত আর অবিচল থেকে স্বীয় কর্তব্য সাধন করতে পারি, তার ওপরই নির্ভর করবে আমাদের সফলতা। পৃথিবীতে সে মানুষই সবচেয়ে সফল আর সুখী, যে সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে এবং যে কোনো পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে অথবা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। সুতরাং আসুন, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করি; এই সময়টাকে যতটা পারি ভারমুক্ত, সুন্দর, সৃষ্টিশীল আর উদ্দেশ্যপূর্ণ করি। এর জন্য আমরা এমন কিছু পন্থা গ্রহণ করি, যা আমাদের প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টিকারী এই সংকটময় পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।

আমরা কভিড-১৯-এ আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই; সুস্থ হওয়ার পর তারা যেন কোনোক্রমেই সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার না হয়, আসুন সেদিকে দৃষ্টি রাখি। কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যারা জয়ী হয়েছেন, এমন সাহসী লোকদের বিষয়ে আসুন জানার চেষ্টা করি। এদের অভিজ্ঞতা আমাদের সাহস জোগাবে; যারা স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।

এ সময় আত্মবিশ্বাসী হই, একটু অন্তর্মুখী হই। নিজেকে জানার চেষ্টা করি। একটা সময় বের করে ধ্যান-যোগাভ্যাস করি। কারণ ধ্যান হলো আমাদের এই অস্থির জীবনে এক শান্তির বিশ্রাম। এখন পরিবারকে সময় দিয়ে সময় কাটাই। পারিবারিক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের সব সদস্য মিলে খোশগল্প করি, হাসি-তামাশা করি।

তারপরও হয়তো বিরক্তি আসবে। একঘেয়েমি কাটার জন্য আসুন মাঝেমধ্যে গল্প-উপন্যাস, কবিতা পড়ি, নাটক দেখি, গান শুনি; একঘেয়েমি দূর করার একটা ভালো উপায় হলো কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা।

আমাদের সন্তানদের এখন স্কুল বন্ধ। তারাও এখন ঘরবন্দি। তারাও একঘেয়েমিতে ভুগছে। সুতরাং তাদের বন্ধুর মতো সাহচর্য দেওয়া দরকার। আসুন, তাদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে তাদের একটা দৈনিক রুটিন তৈরি করে দিই। রুটিনের মধ্যে যেন পড়াশোনা, খেলাধুলা, টিভি দেখা, গান শেখা, ছবি আঁকা, প্রার্থনা করা- সবকিছুই থাকে।

আমরা জানি, এই সংকটকালে আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ভাইবোনরা প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছেন। এই মুহূর্তে আপনাদের মনে যথেষ্ট ভয়, দুশ্চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতার উদয় হবেই; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আপনি আপনার পেশার জন্য উপযুক্ত নন অথবা আপনি দুর্বল, অক্ষম। এই কঠিন সময়ে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা একান্ত প্রয়োজন। তাই দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের যত্ন নিন, সদাসর্তক থাকুন।

সংকট চিরস্থায়ী নয়; এটি অচিরেই কেটে যাবে। রাত শেষে ভোরের আলো আবার আমরা দেখতে পাব- দিনের জন্য সুস্থ থাকুন, শান্তিতে থাকুন আর অবশ্যই কভিড-১৯মুক্ত থাকুন- এ কামনাই করছি।

প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, মানসিক রোগ বিভাগ রংপুর মেডিকেল কলেজ, রংপুর