গত ১৬ এপ্রিলের সমকালে অভিনেতা আফজাল হোসেনের একটি স্মৃতিচারণ পড়লাম। নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ রচিত ধারাবাহিক নাটক বহুব্রীহির স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। ১৯৮৮-৮৯ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ওই নাটকে একজন তরুণ চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আফজাল হোসেন। নাটকটি খুবই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। ওই নাটকের একটি পর্ব ছিল আফজাল হোসেন ও অভিনেত্রী লুৎফুন নাহার লতার বিয়ে সংক্রান্ত। বিয়ের দিন কনে সেজেগুজে তৈরি। মেহমানরা সবাই এসে গেছেন; কিন্তু বরের দেখা নেই। সবাই চিন্তিত। ওদিকে বর আফজাল হোসেন তখন হাসপাতালে একটি বালকের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত। তিনি চলে আসতে চাইলেও বালকটির দরিদ্র মায়ের করুণ মিনতির কারণে আসতে পারছিলেন না। বালকটি একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি বের হলেন হাসপাতাল থেকে। যখন বাড়ি পৌঁছলেন, তখন অতিথিরা সবাই চলে গেছেন। কনেও তার সাজসজ্জা খুলে ফেলে রেগে অ্যাটম বোম্ব হয়ে বসে আছে। আফজাল হোসেন শুধু বললেন, 'আমি এমনই দুর্ভাগা যে, নিজের বিয়েতেও থাকতে পারলোম না।' এরপর কনে লতা তাকে ধরে নিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল।
ঘটনাটি খুব একটা আহামরি গোছের কিছু নয়। কিন্তু আমরা যদি এর মর্মার্থ অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাব- নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ হাস্যরসিকতার ছলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ওই সিকোয়েন্সে তুলে ধরেছেন। সেটা হলো, একজন চিকিৎসকের দায়িত্ববোধ। বিয়ে নয়, বালকটির চিকিৎসা ও তার মায়ের আকুল কান্নাই তখন চিকিৎসক আফজালের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ছেলেটিকে সুস্থ করে তোলাই ছিল তখন অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণেই নিজের বিয়েতে সময়মতো আসা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। বাস্তবিক এমন ঘটনা হয়তো ঘটে না।

আমরা যে ধরনের চিকিৎসক চাই বহুব্রীহির ওই চিকিৎসক নিঃসন্দেহে তার প্রতিবিম্ব; যিনি নিজের চেয়ে রোগীকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। আমরা যখন স্কুলজীবনে পরীক্ষার খাতায় 'তোমার জীবনের লক্ষ্য' প্রবন্ধ লিখতাম, অনেকে চিকিৎসক হওয়াকে সে লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরতাম। আর তাতে আর্তপীড়িতের সেবাকেই প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবেও উল্লেখ করতাম। রচনা লেখা সেসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকে চিকিৎসক হয়েছেন। তবে সেদিনের লক্ষ্যের কথা সবাই মনে রেখেছেন কিনা তা জানা নেই।

চিকিৎসা করা একটি পেশা হলেও এটি একটি ব্রত। মানবিকতা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্য কোনো পেশা এর মতো মানুষ আর মানবিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমি অনেক ভালো চিকিৎসকের দেখা এ জীবনে পেয়েছি, যারা রোগীকে দেবতাজ্ঞানে সেবা দিয়ে থাকেন। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় আমাদের এলাকায় একজন চিকিৎসককে দেখতাম ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে রোগীর সন্ধান করে তাদের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু কোনো ফি নিতেন না। অনেক সময় ওষুধও মাগনা দিতেন। সেই ৫৫-৫৬ বছর আগে দেখা সেই গরিবের চিকিৎসকের নাম সুরেন্দ্র বর্ধন। তবে সবাই তাকে 'কান্ডু ডাক্তার' নামেই চিনত। তার ছেলে সুকুমার বর্ধন পরবর্তীকালে ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের মেডিকেল অফিসার ছিলেন।

অসংখ্য চিকিৎসক আজ আমাদের চারপাশে। তারা মানুষের চিকিৎসা করছেন, নাম, যশ, খ্যাতি অর্জন করছেন। কারও কারও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। তবে তাদের কতজন এ পেশাকে মানবসেবার ব্রত হিসেবে নিয়েছেন, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আবার তাদেরই কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সৃষ্টি করেন ইতিহাস। তাদের দায়িত্ববোধ আর আত্মোৎসর্গের খবর চিকিৎসকদের সম্পর্কে সৃষ্ট নেতিবাচক ধারণাকে বদলে দেয় তখন। তেমনি একজন ডা. মইন উদ্দিন; যার আত্মত্যাগ তাকে করে তুলেছে মহান।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর অনেকেই আঙুল তুলেছিলেন চিকিৎসকদের দিকে। তারা প্রাণের ভয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন, করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে চাচ্ছেন না ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছিল তখন। কিন্তু তারা এটা ভেবে দেখেননি যে, এই নিদানকালে সৃষ্টিকর্তার পরে চিকিৎসকরাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। তারা যে সাহস নিয়ে এ মরণব্যাধির বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছেন, তা কি প্রশংসাযোগ্য নয়? নানাদিক থেকে বলা হচ্ছে, আমরা করোনাযুদ্ধের মধ্যে আছি। যদি এটা যুদ্ধ হয়, তাহলে এ যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন সোলজার কারা? নিঃসন্দেহে চিকিৎসকরা। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের। এ ভাইরাস তাদেরও আক্রান্ত করতে পারে জেনেও পিছপা হননি দায়িত্ব পালন থেকে। আর তাই সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মইন উদ্দিনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে জানার পর আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে, চোখ হয়েছে অশ্রুসজল, শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে এসেছে আপনাআপনি। তিনি হয়ে উঠেছেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করার মূর্ত প্রতীক।

প্রশ্নটা উঠেছিল শুরুতেই। করোনাযুদ্ধে যারা সম্মুখ সমরে লিপ্ত, আমরা কি তাদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পেরেছিলাম? ছিল কি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বর্ম, মানে পিপিই? এখন হয়তো তা পাওয়া গেছে। কিন্তু প্রথম দিকে যে তা পর্যাপ্ত ছিল না, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। সেই অপ্রস্তুত মুহূর্তে কেউ কেউ যদি বিনা অস্ত্রে যুদ্ধে যেতে রাজি না হয়ে থাকেন, তাকে কি খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে? আপনি আপনার যোদ্ধাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র আর সুরক্ষা সরঞ্জাম না দিয়েই যুদ্ধে পাঠালে তাতে মানুষ তো রক্ষা পাবেই না, বরং যোদ্ধাদেরই বেঘোরে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। তারপরও আমাদের চিকিৎসকরা বসে থাকেননি। সীমিত শক্তি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন করোনাবিরোধী লড়াইয়ে।

গত ১৬ এপ্রিল সমকালের এক খবরে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ৯০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫২ জন চিকিৎসক, ৫ জন আইডিসিআর কর্মী, ২৮ জন নার্স, চারজন টেকনোলজিস্ট রয়েছেন। অন্যদিকে এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সাহসী সৈনিকের ভূমিকা পালনকারী গণমাধ্যমকর্মীদের ছয়জন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্য ও পাঁচ ব্যাংক কর্মীর আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা জেনেছি। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আক্রান্তরা যে যার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে করোনাযুদ্ধ সোলজারের ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছিলেন। তাদের এ কাজকে যদি আমরা শুধুই চাকরিগত দায়িত্ব পালন হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে বড় রকমের অবিচার করা হবে। যে সময়ে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিকরা করোনা মোকাবিলায় জানবাজ লড়াইয়ে লিপ্ত, তখন তাদেরকে উৎসাহিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
করোনাযুদ্ধে প্রথম আত্মদানকারী বীর ডা. মইন উদ্দিন। আমরা বিশ্বাস করি, তার এ আত্মদান বিফলে যাবে না। কারণ, মানুষের জন্য আত্মদান কখনও বৃথা যায় না। সরকার নিশ্চয়ই এ বীরকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে স্মরণীয় করে রাখার উদ্যোগ নেবে; যাতে জাতির সংকটকালে এভাবে দায়িত্ব পালনে অন্যরা এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়। সালাম বীরযোদ্ধা ডা. মইনকে।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক