গত প্রায় পাঁচ বছরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কিংবা এ সংকট নিরসনে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত কোনো সুফল মেলেনি। গত বুধবার এ ইস্যুতে জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার বিষয়টি বিদ্যমান সংকটে আশার আলো বলা যায়। আমাদের সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি সংগত কারণেই গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এ-ও দেখলাম, জাপান-রাশিয়া-চীন এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ফের তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। তারা এ প্রস্তাবের সঙ্গে থাকার পরও তাদের অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়েছে। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। আমরা এ দাবি নিশ্চয়ই করতে পারি, তাদের পূর্বতন অবস্থানের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এর আগেও যখন এমন প্রস্তাব জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে উঠেছিল তখন তাদের অবস্থান যা-ই হোক, এবার তারা এর বিপক্ষে দাঁড়ায়নি; আপাতদৃষ্টিতে একটু ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমরা এ ব্যাপারে যে জায়গায় যেতে চাই অর্থাৎ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা তাদের ভিটেতে ফিরে যাক, এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য যে পরিবেশ কিংবা অনুকূল পরিস্থিতি রাখাইনে নিশ্চিত হওয়া জরুরি, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রকৃত মনোভাব কী?

এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতি তাৎপর্যপূর্ণ। তারা বলেছে, এ সর্বসম্মত প্রস্তাব অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গৃহীত এ প্রস্তাবে মিয়ানমারকে অনেক বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এবার যেটুকু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হলো তাতেই সব স্বস্তি খোঁজার অবকাশ নেই। সাধারণ পরিষদে এমন প্রস্তাবের কার্যকারিতার বাস্তবে প্রতিফলন ঘটেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, অতীতের প্রস্তাব তো এবারের মতো সর্বসম্মত ছিল না। কথাটা অমূলক নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অনেকেই তাদের কথামাফিক কাজ করেনি। ইতোমধ্যে কয়েকবার জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এ ব্যাপারে গৃহীত প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও পাস হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার নির্দেশিত পথে হাঁটেনি। তৃতীয় কমিটি এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করে। তা এখন আবার সাধারণ পরিষদে যাবে।

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এ প্রস্তাব পাস হলে নিরাপত্তা পরিষদেও যাতে তা পাস হয়- এখন লক্ষ্য হতে হবে সেটিই। ধারণা করি, যেহেতু তৃতীয় কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে, সেহেতু সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এ নিয়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। ধরে নিলাম, তা হলোও না। কিন্তু মিয়ানমারের মনোভাব যদি এ ব্যাপারে ইতিবাচক না হয়, তাহলে সংকট নিরসনের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা থেকেই যাবে। প্রথমত, মিয়ানমারের তরফে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্বভূমে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ জন্য তাদের ওপর বহুমুখী চাপ অত্যন্ত জরুরি। বলতে পারি, সেই চাপ সৃষ্টির পথ কিছুটা হলেও সুগম হলো। জাতিসংঘের বিভিন্ন শাখায়ও এ ব্যাপারে প্রস্তাব আছে। কিন্তু মিয়ানমার নড়ছে না। বর্তমানে সেখানে সামরিক সরকার সরাসরি ক্ষমতায়। আগে তারা ছিল পরোক্ষ সহায়তাকারী।


গত কয়েক মাসে সেখানকার বর্তমান সরকারের এ ব্যাপারে এমন কোনো কার্যক্রম আমরা দেখিনি, যা পূর্বতন সরকারের কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্নতর কিছু। এর পরও বলব, এবারের প্রস্তাবে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জায়গা আমাদের আছে- তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই স্বস্তি বিদ্যমান সংকট নিরসনে চূড়ান্তভাবে যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে সমাধানের একটা বড় রাস্তা তৈরি হতে পারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে। যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য তাদের ঐকমত্য খুব জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আছে। চীন, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স- এসব রাষ্ট্রকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। তবে এ জন্য এখন দরকার নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমাদের আরও জোরালো ও দূরদর্শী কূটনৈতিক তৎপরতা। চীন ও রাশিয়ার অবস্থান এ ব্যাপারে আমাদের পুরোপুরি অনুকূলে, তা বলতে পারছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মতো শক্তিধর অন্যরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ ব্যাপারে ঐকমত্য হয়ে প্রস্তাব পাস না করবে ততক্ষণ কাঙ্ক্ষিত ফল আশা করা যায় না।

যদি তা হয় তাহলে বাস্তবিক অর্থে মিয়ানমারের ওপর চাপ কঠোর হবে এবং মিয়ানমার তার অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হবে। এ জন্য দরকার বহুপক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ। চীন, জাপান, রাশিয়া- এসব দেশের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। তারা সবাই আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাদের আর্থিক সহযোগিতায়। আমরা এ সূত্রে তাদের এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো অবস্থা যদি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আশা করা যায়, সংকট নিরসনের পথ মসৃণ হবে। কারণ, তাদের সঙ্গে মিয়ানমারেরও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে সেরকম শক্তিশালী অবস্থানে এখন পর্যন্ত যেতে পেরেছি, তা বলা মুশকিল।

এখন আন্তর্জাতিক সব জোট ও সংগঠনকে আরও সক্রিয় করতে আমাদের কূটনীতির নতুন ছক কষে কাজ করতে হবে। জাপানের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক বিদ্যমান সেখানে আরও কাজ করার সুযোগ আছে বলে মনে করি। চীন, জাপান, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তা যে আমরা রাজনৈতিকভাবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাজে লাগিয়ে সফল হতে পেরেছি, তাও বলা যাবে না। আমাদের সার্বক্ষণিক লক্ষ্য হতে হবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া কীভাবে উত্তরোত্তর জোরালো করা যায়। এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করতে হবে আরও। বহুপক্ষীয়ভাবেও থাকতে হবে এ লক্ষ্য। নিরাপত্তা পরিষদে যদি সদস্য দেশগুলোর ইতিবাচক অবস্থান নিশ্চিত করা যায় তাহলে মিয়ানমারকে তার অবস্থান পাল্টাতে আমাদের জন্য হবে বড় আশার ক্ষেত্র। আমাদের বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী সব রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার সব রকম প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।

কূটনীতির গভীরতা ও দূরদর্শিতা দুই-ই বাড়ানো জরুরি। যেমন এবার জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটির প্রস্তাবে ১০৭টি দেশের পূর্ণ সমর্থন আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যেরই সাক্ষ্যবহ। আগে এমন প্রস্তাবে অনেক দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে কিংবা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। কিন্তু এবার যে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল তাতে মিয়ানমারের কাছে নতুন করে এ বার্তা যাবে- রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে তাদের অনড় থাকার সুযোগ কমছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ ব্যাপারে ইতিবাচক। মিয়ানমারের তরফে এ বিষয়টি দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্য অনেক। তারা হয়তো ভাবছে, বিষয়টি দীর্ঘায়িত হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ ব্যাপারে মনোযোগ কমে যাবে। কিন্তু এবারের এ ঘটনা তাদের সে ভাবনায় দাগ টেনে দিয়েছে। তবে আমাদের এখানেই স্বস্তি খুুঁজলে চলবে না। থেমে থাকলেও হবে না। এ সংকট নিরসনে যতভাবে পারা যায় মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর পথে আমাদের ছক কষে হাঁটতে হবে। অব্যাহত প্রচেষ্টার সুফল নিরাপত্তা পরিষদেও দেখতে পাব- এ আশাই রাখি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত