
লেখাটির শিরোনাম 'উলানিয়ার গাফ্ফার চৌধুরী' হলে যথার্থ হতো না। কারণ তিনি নির্দিষ্ট এলাকার গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করা শিশুটি এখন সব বাঙালির আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বস্তুত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি- এ অমর গানের রচয়িতাকে আঞ্চলিকতার জাল দিয়ে একটি গ্রামের মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধ করে রাখার অবকাশও নেই। তবে জন্মস্থানের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় সামান্য ঘাটতি ছিল না। উলানিয়া থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে বয়ে যাওয়া লালগঞ্জ নদীর স্মৃতি ঘিরে তিনি একটি কবিতা লিখেছেন 'লালগঞ্জের তীরে সূর্যোদয়'। কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি- '.....গহনার নৌকা চলে, যাবে উলানিয়া/ নদীতে সূর্যের রং অস্থির অধীর/ নদীর ঢেউয়ের চেয়ে অস্থির অধীর আমার মন/ কাক ডাকা শিউলী ফোটা হেমন্তের ভোরে/ লালগঞ্জে জোয়ার এসেছে।' ১৯ মে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট- বহু গুণে গুণান্বিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে দেশের খ্যাতিমান অনেকেই লিখছেন। আমি শুধু উলানিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরব।
উলানিয়ায় আমার জন্ম। তখনও স্কুলের বারান্দায় পা রাখিনি। সেই শৈশবের কোনো এক ২১ ফেব্রুয়ারি উলানিয়া করোনেশন হাই স্কুলে মাইকে বেজে উঠল 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।' সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখ থেকে শুনলাম এ গানের রচয়িতার পরিচয়। শীতকালে উলানিয়া বাজার ও আশপাশের মাহফিলে গিয়ে কোনো কোনো বক্তার মুখে গাফ্ফার চৌধুরীকে ঘিরে অনেক কুরুচিপূর্ণ ফতোয়াও শুনেছি। প্রগতিশীলদের মুখে প্রশংসা আর মৌলবাদীদের মুখে কুৎসা শুনে উলানিয়া থেকে মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পার করে ঢাকা এসে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হই।
২০০৭ সালের মার্চে অনেক বছর পর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দেশে এলেন। সেবার (৩০ ও ৩১ মার্চ) তিনি দু'দিনের জন্য উলানিয়া গেলেন। উলানিয়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রাহিমা বেগম মিলনায়তনে নাগরিক সমাজের সেই সংবর্ধনায় আমিও ছিলাম। বক্তারা যোগ্য সন্তানের জনক-জননী হিসেবে প্রয়াত হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ও জহুরা খাতুনকে অভিবাদন জানান। সেই নাগরিক সংবর্ধনায় উলানিয়ার আরেক সন্তান কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, 'তিক্ত কথাকে কীভাবে মিষ্টভাবে বলা যায় তা গাফ্ফার ভাইয়ের কাছে শিখেছি।' সেই সময় মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন থেকে উলানিয়াকে রক্ষার দাবি ওঠে। জবাবে গাফ্ফার চৌধুরী ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এর পর গাফ্ফার চৌধুরী সর্বশেষ উলানিয়া গিয়েছিলেন ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর। আমাদের উলানিয়া করোনেশন হাই স্কুলের শতবর্ষপূর্তি হয় ২০১২ সালে (এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী)। কিন্তু অনুষ্ঠানটি হয় ২ বছর পর। সেই অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদও ছিলেন। গাফ্ফার চৌধুরী উলানিয়া করোনেশন হাই স্কুল মাঠে তাঁর শৈশবে ফুটবল খেলার স্মৃতিচারণ থেকে শুরু করে উলানিয়া ঘিরে অনেক কথা বলেন। সেটিই ছিল গ্রামের বাড়িতে তাঁর শেষ যাওয়া। এর পর কয়েকবার দেশে এলেও তারিখ নির্ধারণ করার পরও শারীরিক জটিলতায় আর যাওয়া হয়নি। তবে টেমস নদীর তীরের লন্ডনে বসেও তিনি উলানিয়া নিয়ে ভাবতেন। নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। উলানিয়া থেকে ২০০৩ সালে মেঘনা নদীর দূরত্ব ছিল ৬ কিলোমিটার। হঠাৎ ভয়াবহ ভাঙনে এখন বলা যায় উলানিয়া মেঘনার তীরে অবস্থিত। তবে যদি বাঁধ দেওয়া না হতো তাহলে হয়তো এতদিনে উলানিয়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। উলানিয়ার নদীভাঙন প্রতিরোধে একনেকে অনুমোদিত ৩৮৬ কোটি টাকার কাজ শেষ পর্যায়ে। এ অর্থ বরাদ্দে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অবদান উলানিয়াবাসী কোনোদিন ভুলবে না। 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যতবার গাফ্ফার চৌধুরী দেখা করেছেন, তিনি বলেছেন- আমাদের গ্রামটা বাঁচাও; ততবারই প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন- চাচা, আমি বেঁচে থাকতে আপনার গ্রাম ভাঙতে দেব না।' (২৮ মার্চ ২০২২ সমকালে প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার থেকে)।
গত সংসদ নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় দৈনিকে নিজ এলাকার রাজনীতিতে দুবৃত্তায়ন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। এর জের হিসেবে একজন রাজনীতিবিদ তাঁকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন। কিন্তু পরে যখন সেই রাজনীতিবিদ তাঁর কাছে যান, তিনি স্বভাবসুলভ ঠোঁটের নিচে হাসি দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর মহান হৃদয়ের বৈশিষ্ট্য। ৮৭ বছর ৫ মাস ৭ দিন বয়সে চলে যাওয়াটা অকালপ্রয়াণ না হলেও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে উলানিয়াবাসী অভিভাবক হারানোর শোকে কাতর। তবে তাঁরা বিশ্বাস করে একুশের গানের রচয়িতার দৈহিক প্রয়ান হলেও যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন তিনি অমর।
মন্তব্য করুন