
নির্বাচন কমিশন রংপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে। ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৮ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ এবং প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ ডিসেম্বর। ২০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রংপুর সিটিতে পুরোনো পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ১৮টি। কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার আগে কেউ নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না। ওই দিন থেকে নির্বাচন শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রচারের সুযোগ রয়েছে।
সমকালে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে এই ধারণা হতে পারে- নিয়ম শুধু লেখা আছে কাগজে, মাঠে তার বালাই নেই। রংপুরে নির্দেশনা কেউ মানছেন না। প্রতীক বরাদ্দের আগে মিছিল-মিটিং কিংবা শোডাউনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিষেধাজ্ঞা মানছেন না কেউ। বিশেষ করে নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোয় সন্ধ্যার পর থেকে চলছে জমজমাট নির্বাচনী প্রচার। গভীর রাত পর্যন্ত প্রার্থীদের সভা-সমাবেশ ও শোডাউনে মুখর নানা এলাকা। ঢাকঢোল পিটিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে ভোটারদের। প্রতিটি ওয়ার্ডেই নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী আচরণবিধি যত গর্জে তত বর্ষে না। হরহামেশা আচরণবিধি ভঙ্গ করা আইন না মানার সমান। আইন বাস্তবায়নের কোনো দায় কি নির্বাচন কমিশনের নেই? সাম্প্রতিককালে নির্বাচনের একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছে গাইবান্ধায়। জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে নির্বাচনের দিন অনিয়মের অভিযোগ এনে তা বাতিল করেছে কমিশন। বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন বাতিলের ঘটনা এটিই প্রথম। নির্বাচনের দিন অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কমিশনকে কেউ কেউ বাহবা দিয়েছেন, আবার অনেকেই সমালোচনা করেছেন। একদিনে একটি আসনে নির্বাচন করার সক্ষমতা না থাকলে ৩০০ আসনে কীভাবে নির্বাচন করবে- এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধার নির্বাচনের পরে রংপুরের সিটি নির্বাচন ইসির সক্ষমতা প্রমাণে আরেকটি ময়দান।
সিটি নির্বাচন আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের আগে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার চালানোর কোনো সুযোগ নেই। দেয়াল লিখন, পোস্টার, বিলবোর্ড, ব্যানার, তোরণ ও গেট তৈরি নিষিদ্ধ। ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রচার, সড়কে যানজট সৃষ্টি করে প্রচার কিংবা খাবার বিতরণ আচরণবিধির লঙ্ঘন। কিন্তু রংপুরে নির্বাচন ঘিরে এখনই যেভাবে নিয়ম ভাঙার মহড়া দেখা যাচ্ছে, তাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। কমিশন এখন চুপচাপ থেকে নির্বাচনের দিন যদি অনিয়ম দেখতে আইনের বই খুলে বসে, তখন তা প্রার্থী, ভোটার এবং নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য সুখকর কিছু নয়। প্রথম থেকেই নিয়ম মানতে বাধ্য করা হলে নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ অনেকটা নিশ্চিত করা যায়। সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রার্থী, কর্মী, সমর্থক, ভোটারদের প্রথমেই নির্বাচনী বিধান স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিধি ভঙ্গের শাস্তির কথাও জানাতে হবে। আইন অমান্য করার শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা আগে থেকেই জানানো হলে আইন ভঙ্গের সাহস কেউ করবে না।
যেসব দেশে ভোটাধিকার নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় না, সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচন হচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন দল লিখিত-অলিখিত কিছু আচার-আচরণ মেনে চলে। এ রকম একটি পরিস্থিতি আমাদের দেশে কল্পনা করা দুরূহ যে রাজনীতিবিদরা ক্রমাগত ইসির ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাবেন আর ইসি শুধু সাংবিধানিক সংস্থা হওয়া এবং সরকারের চাপমুক্ত থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় আমাদের দেশে কোনো কিছুই যেন আর পরিমিতি বোধের মধ্যে থাকছে না। এখানে সংযম ও চক্ষুলজ্জা প্রায় উঠে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় রংপুরের সিটি নির্বাচন নিয়ে কমিশনের আগাম প্রস্তুতি এবং প্রার্থীদের নিজেদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে- ভোটের উত্তাপ কেবল ভোটের মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকবে; নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের প্রাত্যহিক কাজে বিঘ্ন করে প্রচারণা করা যাবে না; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রচারণার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিয়ে ভোটের প্রচার চালানোর মতো আচরণ রপ্ত করতে হবে; ভোটারদের অতিষ্ঠ করে ভোট চাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এহ্সান মাহমুদ : সহ-সম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন