গতকাল ১ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৪ ও ৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২- এ ছয়টি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল। জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপি সদস্যদের পদত্যাগের ফলে শূন্য হওয়া আসনের এই উপনির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি কারও মধ্যেই। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ এবং সংবাদচিত্র বিশ্নেষণ করে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। তবে ব্যতিক্রম ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এবং বগুড়া-৪ ও ৬ আসনে। আরও পরিস্কার করে বললে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া এবং বগুড়ার আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। নির্বাচনের উত্তাপ ফিরে না এলেও এ দুই প্রার্থী ঘিরে আলোচনা ও হইচই হয়েছে।

উকিল আবদুস সাত্তার বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও দীর্ঘদিনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য। সংসদ থেকে বিএনপিদলীয় সদস্যরা পদত্যাগ করেছিলেন বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে। সেখানে উকিল সাত্তার পদত্যাগ করে আবার নির্বাচনে নামলে বিএনপি তাঁকে বহিস্কার করে। অপরদিকে ইউটিউবে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে পরিচিতি পাওয়া হিরো আলম নির্বাচনের মাঠে নামার পর থেকেই আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল। এর আগে ২০১৮-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটের দিন কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছিলেন হিরো আলম। বিএনপির দলছুট উকিল সাত্তার এবং ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতা হিরো আলম ঘিরেই এই দফা উপনির্বাচনে মিছিলের স্লোগান কিছুটা শোনা গেল।

গতকাল বুধবার উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে বিকেলে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি সেখানে বলেছেন, 'ভোটার উপস্থিতির হার তুলনামূলক কম ছিল। আনুমানিক ১৫-২০ থেকে ২৫ শতাংশ হতে পারে। তবে নিশ্চিত করে এখনও বলা যাবে না। এ জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।' ছয়টি আসনেই ভোট হয়েছে ইভিএমে। বুধবার দিনভর সংবাদমাধ্যমে যে চিত্র দেখা গেছে, তাতে ভোটার উপস্থিতি আরও কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এই ছয়টি আসনের মধ্যে তিন আসনে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঠাকুরগাঁও-৩ এবং বগুড়া-৪ আসন দুটি ছেড়ে দিয়েছিল জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে তারা প্রার্থী তো দেয়ইনি; উপরন্তু দলটির নেতাকর্মী সমর্থন দিয়েছেন বিএনপির বহিস্কৃত নেতা গতবারের এমপি উকিল সাত্তারকে। জাতীয় পার্টি ছয় আসনে প্রার্থী দিলেও টিকে ছিল পাঁচ আসনে; একজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল বাছাইয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জাতীয় পার্টির মো. আবদুল হামিদ প্রার্থী হলেও সেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থন তিনি পাননি।
উত্তাপহীন উপনির্বাচনের শুরুতে উকিল সাত্তার এবং হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনা হলেও নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁদের দু'জনকে ছাপিয়ে গেলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ। হঠাৎ 'নিখোঁজ' হওয়ার খবর আসে উকিল সাত্তারের এই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর। আসিফের স্ত্রী মেহেরুন্নিসা তাঁর স্বামীর অন্তর্ধানের জন্য পুলিশের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে কোনো প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, এর সঙ্গে সরকারি কোনো বাহিনী জড়িত নয় বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। ভোটের মাঠে থাকা একজন প্রার্থী কী করে নিখেঁাঁজ হলেন? যেখানে এই আসনের নির্বাচন ঘিরে, বিশেষ করে উকিল সাত্তারকে বিজয়ী করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী সোচ্চার; সেখানে আসিফ আহমেদের নিখোঁজ হওয়া কী বার্তা দেবে? যে আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো প্রার্থীই নেই, সেখানেও যদি কৌশলগত কারণে কোনো প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য অপর প্রার্থীকে 'আড়ালে' রাখা যায়, তাহলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ নিজেই থাকলে প্রতিপক্ষের অবস্থা কী হবে- তা সহজেই অনুমান করা যায়। সম্প্রতি গাইবান্ধার উপনির্বাচনের সময় ভোটকক্ষে 'ডাকাত'-এর উপস্থিতির কথা প্রথম বলেছিলেন সিইসি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনেও উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার পক্ষে এমন ডাকাত দেখা গেছে। অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের তিনটি ভোটকেন্দ্রের ১৪টি ভোটকক্ষের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখা গেছে। আবার ইভিএমে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি থাকলেও এবার বগুড়া-৬ উপনির্বাচনে আঙুলের ছাপ না মেলার ঘটনাও ঘটেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগও ছিল। বগুড়া-৬ উপনির্বাচনে নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। ঠাকুরগাঁও-৩ উপনির্বাচনে মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরাসরি কোনো প্রার্থী না থাকায় ভোটের শুরু থেকেই ভোটারদের মধ্য কিছুটা আগ্রহের ঘাটতি ছিল। ভোটের দিনও তার প্রমাণ দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদের শেষদিকে এসে এই উপনির্বাচন বেশকিছু প্রশ্ন জাগিয়ে দিচ্ছে। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরার উপনির্বাচন নানা অনিয়মের কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপনির্বাচন। এমনকি হালের 'রাতের ভোট'-এর তকমা পাওয়া ২০১৮-এর নির্বাচনও মাগুরার কাছে আলোচনার টেবিলে বারবার পিছিয়ে পড়ছে। তবে আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদের শেষদিকের ১ ফেব্রুয়ারিতে ৬ আসনের উপনির্বাচন আবার উদাহরণ সৃষ্টি করল; বিশেষত উকিল আবদুস সাত্তারকে জিতিয়ে আনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি দল যা করল, সে কারণে। এমন অভূতপূর্ব নির্বাচন বাংলাদেশ আর দেখেনি- এই কথা মেনে নিতে আমাদের কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মাগুরার উপনির্বাচনের পর দেশে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জোরদার হয়েছিল। এবার ছয়টি আসনের উপনির্বাচনের পর এই দাবি উপেক্ষা করার শক্ত যুক্তি ক্ষমতাসীনদের কাছে আছে কি?

এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল