
আমাদের দেশে সড়কে মৃত্যু যেন থামবে না! সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর দেখা যায়। গুরুতর এই জাতীয় সমস্যাটি কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না বলেই দেখা যাচ্ছে। গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে একটি দুর্ঘটনাতেই ২০ জন নিহত হওয়ার পর দেখা গেল, এক্সপ্রেসওয়েও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না। বিষয়টি এমন, সড়ক-মহাসড়কে মানুষের মৃত্যু ঘটতেই থাকবে। এটা প্রতিরোধে কারও কিছু করার নেই!
এসব দুর্ঘটনার পরে কিছুই কি করার নেই আমাদের? অবশ্যই অনেক কিছু করার আছে। বাংলাদেশ সে অঙ্গীকারও করেছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যারা অঙ্গীকার করেছে; ২০১১ থেকে ’২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে কাজ করবে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। কিন্তু আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, সেই অঙ্গীকার পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছে? আমাদের দেশে কী কী কারণে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে; কী কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব– এসবও বহুল আলোচিত বিষয়।
অনেক গবেষণা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। আবার চালকদের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার মতো বিষয়ও রয়েছে। ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় সড়কে ঘুম চোখে গাড়ি চালাতে গিয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনার নজির আছে।
আরও কৌতূহল উদ্দীপক, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য সরকারি তহবিল থাকলেও তা থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩(১) ধারা অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় হতাহতরা ক্ষতিপূরণ পাবেন আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে। গত ২৭ ডিসেম্বর কার্যকর সড়ক বিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি যানবাহনের কাছ থেকে বার্ষিক চাঁদা নেওয়া হচ্ছে এই তহবিলে। সরকারি হিসাবেই বছরে ১০ হাজারের বেশি দুর্ঘটনায় হতাহত হলেও তহবিল পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পর প্রচার না থাকায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে এ পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ছয়টি। দুর্ঘটনায় কর্মক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু বা পঙ্গুত্বে তাঁর পরিবার পথে বসে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজির বিরল।
২০১৯ সালের ১ নভেম্বর কার্যকর হওয়া সড়ক পরিবহন আইনে হতাহতের সহায়তায় তহবিলের ব্যবস্থা রাখা হয়। বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৮। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯টি। চলতি বছরে নিবন্ধিত ৬১ হাজার ২টি মোটরসাইকেলের কাছ থেকে ৬ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার টাকা চাঁদা এসেছে তহবিলে।
এ সময়ের মধ্যে যে ছয়টি ক্ষতিপূরণের আবেদন এসেছে, সেগুলো তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে। হতাহতের ঘটনা সত্য হলে সহায়তা পাবেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে এখনও কেউ পাননি। গত বছর ত্রিশালে ট্রাকচাপায় নিহত মায়ের পেট ফেটে সড়কে জন্ম নেওয়া শিশুকে বিশেষ নির্দেশে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ নির্দেশনা বা বিশেষ ঘটনা কখনও অনুসরণীয় হতে পারে না। নিয়মের ধারাবাহিকতা যাতে রক্ষিত হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের লক্ষ্যে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রথম কাজ। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলপারদের দিয়ে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল– এসব বন্ধ করতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালককেই যেন লাইসেন্স দেওয়া হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার যাতে যথাযথ ক্ষতিপূরণ পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি দুর্ঘটনা যেমন আমাদের অপ্রত্যাশিত, তেমনি প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করাও দায়িত্ব।
এহ্সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন