
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে ডজনখানেক প্রশিক্ষকের সঙ্গে একজন পরিচালক আছেন শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চায় সহযোগিতা করতে; অথচ সে দায়িত্ব পালন তো দূরে থাক, সেখানকার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নাকি শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রমুখো না হওয়ার পরামর্শ দেন। আশ্চর্যজনক হলো, এরপরও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। এ হতাশাজনক খবরটিই শনিবার সমকালে প্রকাশিত হয়েছে; সেখানে শিক্ষার্থীদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, হল ও বিভাগের গুটিকয়েক প্রতিযোগিতার আয়োজন ছাড়া বছরজুড়ে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই। উপরন্তু, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে এলে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাহজাহান আলী নাকি তাঁদের বলেন– ‘এত খেলাধুলা করে কী হবে? পড়াশোনা করো, বিসিএসে মনোযোগ দাও।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবশ্যই ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে রুটিন অনুযায়ী পড়াশোনা করবেন। কিন্তু কর্মজীবনে ভালো করতে হলে সুস্থ দেহ-মনও গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়; এরই অংশ হিসেবে জনগণের করের টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয়েছে টিএসসি বা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান। শাহজাহান আলীর কথায় বোঝা যায়, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে তাঁর কোনো কাজ নেই। তাহলে তো তাঁরও সেখানে চাকরি করার কোনো সুযোগ নেই। আপনা বুঝ তো নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ লোকও বোঝেন; কিন্তু শাহজাহান আলী কি বুঝতে পারছেন, এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরণের মধ্য দিয়ে নিজেরই পায়ে তিনি কুড়াল মারছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই কি একজনকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে! এখান থেকে পাস করে অনেকেই উদ্যোক্তা হবেন। যাঁদের গড়া প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হবে হাজারো মানুষের। কেউ কেউ রাজনীতিবিদ হবেন; মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হবেন। বিসিএস ক্যাডার হতে হলে কি খেলাধুলা, শরীরচর্চা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে থাকতে হবে?
তরুণ সমাজ যাতে মাদকাসক্ত না হন এবং বিষণ্নতায় না ভোগেন, সেজন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বারবার খেলাধুলায় আগ্রহী হওয়ার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা। কোনো সচেতন শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই পড়াশোনা বাদ দিয়ে খেলতে যাবেন না। বরং খেলার সময়ে তিনি খেলতে যাবেন।
প্রতিবেদন মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে উপদেষ্টা, পরিচালকসহ ১২ জন প্রশিক্ষক থাকলেও তাঁরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন না। শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের একজন উপপরিচালক বাফুফের হেড অব রেফারিজ, আরেকজন উপপরিচালক আবাহনীর চুক্তিভিত্তিক কোচ, একজন সহকারী পরিচালক বসুন্ধরা কিংসের সাবেক কোচ। এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুলের ক্লাবে প্রশিক্ষকরা কোচিং করান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না জানিয়েই। দিনের পর দিন এ অবস্থা চলে কীভাবে? তবে এ থেকে বোঝা যায় কেন শাহজাহান আলী ও তাঁর সহযোগীরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রমুখো না হতে পরামর্শ দেন।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এটিকে এখনও দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে এ ধরনের অনিয়ম মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ নিজ কর্মস্থলে কাজ না করে কিংবা বিনা অনুমতিতে অন্য প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হলে তা যদি কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট তদারকি কর্মকর্তার অযোগ্যতার চিত্রই সামনে আসে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে উপাচার্যও এর দায় এড়াতে পারেন না।
জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিমান ভাড়া বহনের শর্তে ‘ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফেস্টিভ্যালে’ অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায় আয়োজক রাশিয়া। কিন্তু ঢাবিতে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় না থাকা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে নাম পাঠাতে রাজি নন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। যদিও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও স্পোর্টস বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ দাবি করেছেন, সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে, অংশগ্রহণের বিষয়ে ই-মেইল পাঠানো হবে। রাশিয়ায় খেলোয়াড় দল পাঠানোর শেষমেশ কী হবে তা আমরা জানি না; তবে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রটির যে খোলনলচে বদলে দেওয়া প্রয়োজন তা হলফ করেই বলা যায়।
মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন