ঢাকা সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ইশতেহার

গবেষণাহীন জাতি দিশা হারাবে না কেন

গবেষণাহীন জাতি দিশা হারাবে না কেন

সুলতান মাহমুদ

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

ক্রমেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ওই ইশতেহারে ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালে নিরাপদ ব-দ্বীপ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং মাথাপিছু গড় আয় ৫ হাজার ৯০৬ ডলারের ওপরে নেওয়ার ঘোষণা থাকবে। একই সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ এবং মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ ডলারের ওপরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার বিস্তারিত থাকবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন, দেশকে এগিয়ে নিতে যথাযথ পরিকল্পনা যেমন হচ্ছে, তেমনভাবে এর ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে নির্ভুল গবেষণা এবং জনগণের মানসিকতা গড়ে উঠছে কিনা? এ ক্ষেত্রে কি শুধু সরকার ভূমিকা রাখতে পারবে, নাকি আমাদেরও দায় রয়েছে? আমি মনে করি, সরকারের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি সাধারণ জনগণেরও। তবে বেশি দায় রয়েছে শিক্ষক ও গবেষকদের।

সমাজকে গভীরভাবে জানার অন্যতম পন্থা হলো গবেষণা। বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন তথা উন্নয়ন প্রশ্নে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি নিজের সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে না; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এ কারণে মানসম্মত গবেষণা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। মূলত গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনকে উৎপাদনশীলতার চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই, তাদের যেমন গবেষণা খাতে স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তেমনি মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে তারা মনোযোগী। জাপান, কোরিয়া, চীনের দিকে যদি আমরা চোখ ফেরাই, দেখতে পাই তাদের গবেষণা কার্যক্রম একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

একটি দেশে বিভিন্ন বাস্তবিক সমস্যা থাকে। সময় যখন আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে, তখন সমস্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধানে যথাযথ গবেষণার বিকল্প নেই। এ জন্য প্রথমত সমস্যা চিহ্নিত করে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভাবনী ফল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োগ করতে হয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানব উন্নয়ন সূচকে বর্তমান বিশ্বে ইতিবাচকভাবে বহুল আলোচিত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এসব অর্জন ধরে রেখে ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অর্জন করার লক্ষ্যে সরকারের গবেষণার দিকে বিশেষ নজর রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আগামীর নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিতও বটে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও ডেলটা প্ল্যান ২১০০ কার্যকরের ক্ষেত্রে গবেষণা খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্যের বিকল্প নেই। বিশেষ করে গৃহীত পরিকল্পনা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গবেষণার বিষয়টি জরুরি। কারণ গবেষণাভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে বিদ্যমান সমস্যাদি সমাধান করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৭) পরিকল্পনা প্রণয়নকালে শিক্ষা ও গবেষণার তাৎপর্য ও গুরুত্ব প্রদান করেন। এমনকি ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ওই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্দেশনা দেন। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয় এবং শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।


শিক্ষকদের জন্য বঙ্গবন্ধু আলাদাভাবে ভাবতেন। শিক্ষকদের বিশেষ সুবিধা কিংবা স্বাধীনতার কথা ভাবতেন। এ জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনসহ বহু নজির স্থাপন করে গেছেন। স্বাধীন অবস্থানের কারণেই সমাজের অন্যায়, সরকারের ভুল বা জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত, নীতি বা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষদের সামনের সারিতে থাকার কথা শিক্ষকদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কিন্তু অনেকেই তা না করে লেজুড়বৃত্তিক দলীয় চিন্তা-চেতনায় মগ্ন। শিক্ষকতার চেয়ে তারা প্রশাসনিক কাজ বেশি উপভোগ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে শিক্ষক রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করেন না, তিনি অনেকটা মূল্যহীন। কারণ তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি দৃশ্যমান হয় না। এ জন্য নিজের ফোকাস তৈরি করতে অনেক শিক্ষক গবেষণায় মনোযোগ না দিয়ে বরং প্রশাসনিক কাজই বেশি উপভোগ করার চেষ্টা করছেন। প্রশাসনিক কাজের অজুহাতে অনেকে শ্রেণিকক্ষেও ঠিকমতো যাচ্ছেন না। সরকারের উচিত হবে কীভাবে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা এবং সে লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারের এটাও উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের আলোচনা-সমালোচনা বিশেষভাবে আমলে নেওয়া। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, গঠনমূলক সমালোচনাকারীদের আমলে না নিয়ে তোষামোদকারীদের ওপর ভর করে সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

শিক্ষকদের উচিত দলীয় চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে গঠনমূলক চিন্তা-চেতনাকে প্রসারিত করে সঠিক এবং সত্য তথ্য লেখালেখির মাধ্যমে জনগণের কাছে তুলে ধরা। কারণ তাদের দায় রয়েছে জনগণের প্রতি। এ দায় জ্ঞানের প্রতি, সত্যের প্রতি।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসাসহ সমাজের নানা বিষয়, বিশেষ করে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, খাদ্য ও পরিবেশের ওপর গবেষণার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং আর্থিক প্রণোদনা বাড়িয়ে তা সহজতর করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। জাতিকে গবেষণামুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণার গুণগত মান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও গবেষককের নির্মোহ, নির্দলীয় ও সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কাজেই সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানাব নির্বাচনী ইশতেহারে গবেষণামুখী কিছু পরিকল্পনা দেওয়ার, যাতে আমাদের দেশকে যথাযথ এবং কাঙ্ক্ষিত মর্যাদায় তুলে ধরা যায়। ড. সুলতান মাহমুদ: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুগ্ম সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি sultanmahmud.rana@gmail.com

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×