- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- করোনাকালে লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা
করোনাকালে লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা

কার্ল মার্কসের দ্বিশতবার্ষিকী পেরিয়ে আমরা এখন লেনিনের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। লেনিনের মৃত্যুর পরও প্রায় কেটে গেছে একশ' বছর। লেনিন আজ অনেকটাই ঐতিহাসিক বিস্মৃতির কবলে। পৃথিবীর বড় অংশজুড়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশে সময়টা আজ যথেষ্ট গোলমেলে। এই গোলমেলে সময়ে উচ্ছ্বাস না হয় নাইবা থাকল, লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা বোধকরি অতীতের তুলনায় আরও বেশিই। সময়টা গোলমেলে আর লড়াইটা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি বলেই লেনিনকে চাই।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর থেকে বামপন্থি মহলেও রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চা বেশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ৭০ বছরে রুশ বিপ্লবের প্রাণশক্তি কেন নিঃশেষ হয়ে গেল সে ব্যাপারে অবশ্যই অধ্যয়ন ও গবেষণা চলতে থাকবে; কিন্তু সে দায়ভার লেনিনের ওপর চাপিয়ে বিপ্লবের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ের লড়াইকেই ভীষণভাবে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
লেনিন ও তার সহযোদ্ধারা যখন রাশিয়ার মাটিতে জারতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেন, তখন তাদের কাছে অনুশীলনগত বা ব্যবহারিক উদাহরণ ছিল যথেষ্ট সীমিত। কমিউনিস্ট ইশতেহার ও পুঁজি থেকে শুরু করে মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের অনেক রচনাই ততদিনে প্রকাশিত হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু অনুশীলনের ভাণ্ডারে জমা পুঁজি ছিল প্যারিস কমিউন, জার্মানির সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সীমিত অভিজ্ঞতা। এখান থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও বিপল্গবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছেন লেনিন, যে অভিযানে তত্ত্ব ও অনুশীলন হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেছে।
প্রাক-লেনিন পর্যায়ে কমিউনিজম বা তার নিকটতর ও প্রাথমিক পর্যায় সমাজতন্ত্র, ছিল একটি ঘোষণাপত্র বা ইশতেহার। এক স্বপ্নের হাতছানি। এক নতুন সমাজের অস্পষ্ট রূপরেখা। লেনিনের জীবদ্দশায় তার তিন দশকের অনুশীলনে এই স্পষ্ট রূপরেখা স্পষ্ট আকার গ্রহণ করতে শুরু করে। মার্কসের চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে এক বিরাট গণউদ্যোগ, গণআলোড়ন দেশে দেশে ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দিতে থাকে গণতন্ত্রের পক্ষে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই যুগান্তকারী মেলবন্ধন পরিচিতি অর্জন করে লেনিনবাদ নামে।
শোষণবিহীন সমাজের মুক্তিকামী স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে নিরলস গতিময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কমিউনিস্ট অনুশীলন-লেনিনকে ফিরে দেখার অর্থ এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার যুদ্ধকে জনতার ক্ষমতা দখলের বিপ্লবী যুদ্ধে রূপান্তরিত করার যে নির্দিষ্ট ও সফল উদাহরণ গত শতাব্দীর গোড়ার পর্বে রাশিয়াতে আমরা দেখেছি, তার হয়তো একইভাবে আর কোথাও পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির যে অধ্যয়ন লেনিন করেছিলেন আজ দানবীয় বিত্তীয় পুঁজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে তার অবশ্যই নতুন সংস্করণের প্রয়োজন। কিন্তু রুশ বিপ্লবকে যারা গণতন্ত্রহীনতার পর্যায়ে প্রাক-আধুনিক সমাজ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের উদাহরণ হিসেবেই শুধু অভ্যস্ত এবং যাদের মনে হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরিপকস্ফতা ও বিচক্ষণতা সেই পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে দিয়েছে আজ তাদেরও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।
লেনিনের সময় থেকে ২০২০-এর বিশ্ব পরিস্থিতির দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেছে। লেনিন নিয়ে আগ্রহ বিশ্বায়িত দুনিয়ার এক বড় অংশের মানুষের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। একদিকে মতাদর্শগত শূন্যতা, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিপদ; একদিকে ভোগবাদের হাতছানি, অপরদিকে এককালের প্রবল পরাক্রমশালী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর অবলুপ্তি তরুণ প্রজন্মকে স্বাভাবিক কারণেই লেনিনের প্রতি অনাগ্রাহী করতে বড় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এটাই আবার শেষ কথা নয়। বিশ্বায়ন, দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত, নয়া-উদারনীতিবাদের দাক্ষিণ্যে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের তাড়নায় মানুষ খুঁজছে এক বিকল্প পথের সন্ধান এবং সেখানেই লেনিন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন নতুন ভাবনায়, নতুন প্রেক্ষিতে। বিশেষ করে লেনিন যে মুমূর্ষু পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে চেয়েছিলেন, তা আজ কভিড-১৯ নামের এক মহামারির জন্য বিপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। একদিকে এ মহামারি যেমন অন্তঃসারশূন্য ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদকে প্রতিপন্ন করছে, তেমনি চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা আর কেরালার বিকল্প ব্যবস্থাপনা নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন আবারও বিশ্ববাসীকে দেখাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, প্লেগ যেমন মধ্যযুগের পর ইউরোপের আলোকায়নকে ত্বরান্বিত করেছিল, তেমনি এ মহামারিও নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার অভ্যুদয় ঘটাবে। সে নতুন ব্যবস্থা কায়েমের লড়াইয়ে লেনিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
হ সাংবাদিক
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর থেকে বামপন্থি মহলেও রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চা বেশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ৭০ বছরে রুশ বিপ্লবের প্রাণশক্তি কেন নিঃশেষ হয়ে গেল সে ব্যাপারে অবশ্যই অধ্যয়ন ও গবেষণা চলতে থাকবে; কিন্তু সে দায়ভার লেনিনের ওপর চাপিয়ে বিপ্লবের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ের লড়াইকেই ভীষণভাবে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
লেনিন ও তার সহযোদ্ধারা যখন রাশিয়ার মাটিতে জারতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেন, তখন তাদের কাছে অনুশীলনগত বা ব্যবহারিক উদাহরণ ছিল যথেষ্ট সীমিত। কমিউনিস্ট ইশতেহার ও পুঁজি থেকে শুরু করে মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের অনেক রচনাই ততদিনে প্রকাশিত হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু অনুশীলনের ভাণ্ডারে জমা পুঁজি ছিল প্যারিস কমিউন, জার্মানির সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সীমিত অভিজ্ঞতা। এখান থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও বিপল্গবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছেন লেনিন, যে অভিযানে তত্ত্ব ও অনুশীলন হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেছে।
প্রাক-লেনিন পর্যায়ে কমিউনিজম বা তার নিকটতর ও প্রাথমিক পর্যায় সমাজতন্ত্র, ছিল একটি ঘোষণাপত্র বা ইশতেহার। এক স্বপ্নের হাতছানি। এক নতুন সমাজের অস্পষ্ট রূপরেখা। লেনিনের জীবদ্দশায় তার তিন দশকের অনুশীলনে এই স্পষ্ট রূপরেখা স্পষ্ট আকার গ্রহণ করতে শুরু করে। মার্কসের চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে এক বিরাট গণউদ্যোগ, গণআলোড়ন দেশে দেশে ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দিতে থাকে গণতন্ত্রের পক্ষে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই যুগান্তকারী মেলবন্ধন পরিচিতি অর্জন করে লেনিনবাদ নামে।
শোষণবিহীন সমাজের মুক্তিকামী স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে নিরলস গতিময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কমিউনিস্ট অনুশীলন-লেনিনকে ফিরে দেখার অর্থ এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার যুদ্ধকে জনতার ক্ষমতা দখলের বিপ্লবী যুদ্ধে রূপান্তরিত করার যে নির্দিষ্ট ও সফল উদাহরণ গত শতাব্দীর গোড়ার পর্বে রাশিয়াতে আমরা দেখেছি, তার হয়তো একইভাবে আর কোথাও পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির যে অধ্যয়ন লেনিন করেছিলেন আজ দানবীয় বিত্তীয় পুঁজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে তার অবশ্যই নতুন সংস্করণের প্রয়োজন। কিন্তু রুশ বিপ্লবকে যারা গণতন্ত্রহীনতার পর্যায়ে প্রাক-আধুনিক সমাজ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের উদাহরণ হিসেবেই শুধু অভ্যস্ত এবং যাদের মনে হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরিপকস্ফতা ও বিচক্ষণতা সেই পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে দিয়েছে আজ তাদেরও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।
লেনিনের সময় থেকে ২০২০-এর বিশ্ব পরিস্থিতির দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেছে। লেনিন নিয়ে আগ্রহ বিশ্বায়িত দুনিয়ার এক বড় অংশের মানুষের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। একদিকে মতাদর্শগত শূন্যতা, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিপদ; একদিকে ভোগবাদের হাতছানি, অপরদিকে এককালের প্রবল পরাক্রমশালী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর অবলুপ্তি তরুণ প্রজন্মকে স্বাভাবিক কারণেই লেনিনের প্রতি অনাগ্রাহী করতে বড় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এটাই আবার শেষ কথা নয়। বিশ্বায়ন, দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত, নয়া-উদারনীতিবাদের দাক্ষিণ্যে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের তাড়নায় মানুষ খুঁজছে এক বিকল্প পথের সন্ধান এবং সেখানেই লেনিন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন নতুন ভাবনায়, নতুন প্রেক্ষিতে। বিশেষ করে লেনিন যে মুমূর্ষু পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে চেয়েছিলেন, তা আজ কভিড-১৯ নামের এক মহামারির জন্য বিপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। একদিকে এ মহামারি যেমন অন্তঃসারশূন্য ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদকে প্রতিপন্ন করছে, তেমনি চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা আর কেরালার বিকল্প ব্যবস্থাপনা নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন আবারও বিশ্ববাসীকে দেখাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, প্লেগ যেমন মধ্যযুগের পর ইউরোপের আলোকায়নকে ত্বরান্বিত করেছিল, তেমনি এ মহামারিও নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার অভ্যুদয় ঘটাবে। সে নতুন ব্যবস্থা কায়েমের লড়াইয়ে লেনিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
হ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন