করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে ঘরে থাকার কোনো বিকল্প নেই। ঘরে থেকে পারিবারিক সম্প্রীতি বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আমরা সবাই যেন মানবিক হই। করোনা একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাস। সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলে আজ এক পালল্গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের কোন রাষ্ট্র কত ক্ষমতাধর! কার কী পরাশক্তি আছে! কোনো কিছুরই পরোয়া নেই করোনার। করোনার কাছে সবাই যেন অসহায়। করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে সবাই এখন ঘরবন্দি সূত্র অনুসরণ করছে। কারণ সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব মেনে না চললে করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। করোনা গোটা বিশ্ববাসীকে এখন ঘরে থাকতে একরকম বাধ্য করছে।
বৈশ্বিক এই দুর্যোগে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, কর্মপরিবেশে সহকর্মী, সবার সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখা এখন সময়ের দাবি। আমি মনে করি, করোনার এই সংকটকালে ঘরের ভেতর সময়টাকে আমরা কে কীভাবে কাজে লাগাব, সেটাই বিবেচ্য। যেমন- অনেকের পক্ষে হয়তোবা কর্মজীবনের ব্যস্ততায় পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে এতটা দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগই পাননি। তারা এ সময়টিকে আনন্দঘনভাবে কাটানোর চেষ্টা করছেন। কীভাবে সন্তানদের সুশিক্ষা দেওয়া যায়, পারিবারিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধগুলো জাগিয়ে তোলা যায়, বিভিন্ন গল্পের ছলে তা করার চেষ্টা করছেন। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবন গঠন অত্যন্ত জরুরি। কেউ কেউ আবার ঘরের ভেতর থেকে থেকে হাঁফিয়ে উঠছেন। ঘরের ভেতর থাকাটাই তাদের অসহ্য হয়ে উঠছে। তারা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে এমন অসহিষুষ্ণ আচরণ করছেন যে, তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছেন। সারাক্ষণ খিটিমিটি কারোরই যে ভালো লাগে না, এটা তারা বুঝতেই পারছেন না। এতে করে তাদের স্ত্রী-সন্তানরা মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যান। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, এ অবস্থায় অনেকেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সুতরাং সবার কাছে অনুরোধ, ঘরের ভেতর থাকুন, ভালো থাকুন। জীবনটাকে আনন্দময় করুন। বাসায় একটি আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে সবাইকে নিয়ে উপভোগ করুন।
এই সংকটকালেও কারও কারও পশুত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নারী-শিশু প্রতিনিয়ত পারিবারিক সহিংসতা, যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ধিক্কার জানাই সেসব নরপশুকে। দ্রুত বিচারে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রত্যাশা করি। মানুষ যেন দিনে দিনে কেমন হয়ে যাচ্ছে, মানবিকতা লোপ পাচ্ছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার সঙ্গে, তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। মনে হয়, তারা যেন 'অচ্ছুত' হয়ে গেছে। আমি মনে করি, তাদের বাঁকা চোখে দেখার কিছু নেই। তারা তো কোনো পাপ করেনি। আমরা যে কেউ যে কোনো সময় এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত। আক্রান্তদের প্রতি আমাদের অনেক বেশি মানবিক হওয়া উচিত। হ্যাঁ, অবশ্যই নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত রেখে আক্রান্ত মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখতে হবে। বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রাখতে হবে। তাদের কোনো কিছুতেই বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। তাদের সাহস দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রত্যেকের খাবার নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, একটি লোকও যেন অভুক্ত না থাকে এবং ত্রাণ বিতরণে যাতে কোনো রকমের অনিয়ম না হয়, সে বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনি। ক'দিন না যেতেই কিছু সংখ্যক লোক তাদের স্বচেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন। কর্মহীন দিনমজুরদের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণের চাল আত্মসাতে তাদের হাত একটু কাঁপছে না।
আবার অনেকেই এগিয়ে আসছেন। অত্যন্ত মানবিকভাবেই এগিয়ে আসেন। উদাহরণস্বরূপ দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য এমপি শিবলী সাদিকের নাম উলেল্গখ করা যায়। ভ্যানে করে রাতের আঁধারে অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। আবার বিপরীত চিত্রও লক্ষ্য করি, তারা অনেকেই প্রচার চান, টিভি ক্যামেরার সামনে ত্রাণ বিতরণের লোক জমায়েতের দৃশ্য দেখাতে তাদের পছন্দ। ত্রাণের জন্য অভুক্ত লোকগুলোর হুড়োহুড়ি, গাদাগাদি করে দাঁড়ানোর দৃশ্য। সামাজিক দূরত্বের বালাইও মানা হয় না সেখানে। তারা যে ত্রাণ বিতরণের নামে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে রাষ্ট্রের বিপদকেই ডেকে এনেছেন, তা বুঝতে পেরেছেন কিনা জানি না। আমাদের সবারই ঘরে থাকা উচিত। কিন্তু আমরা তা মানছি না। নানা অজুহাতে ঘর থেকে বের হচ্ছি। কেননা, বাঙালি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। সামাজিকতা ছাড়া তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গলির মোড়ে, রাস্তায় চায়ের দোকানে বন্ধুজনের সঙ্গে আড্ডা না দিলে পেটের ভাতই হজম হয় না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কেন আমরা ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা যদি নিজেরা সচেষ্ট না হই, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সঙ্গনিরোধ করতে কঠোর থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তা কি আমাদের কারোর জন্যই ভালো হবে?
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব স্তরের জনপ্রিয় ব্যক্তিরা সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, অনুরোধ করছেন ঘরে থাকার জন্য। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী সবাই আকুল আবেদন করছেন ঘরে থাকার জন্য। একজন ডাক্তার যদি কোনোভাবে সংক্রমিত হন, এর ভয়াবহতা হয় অনেক বেশি। কারণ তার সংস্পর্শে আসা বহুজনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে জন্য তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা প্রদানের যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সে বিষয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরও অনেক বেশি সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি করোনার অজুহাতে সাধারণ রোগীরা যাতে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সে বিষয়েও সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবারই চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। করোনা-সংকট উত্তরণের জন্য আমরা যেন সবাই আরও অনেক বেশি মানবিক আচরণ করি। সবার সমবেত প্রয়াসে করোনা সংকটের উত্তরণ ঘটবে- এটাই প্রত্যাশা।
চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন