
সেই আমাদের বাল্যকাল মানে পঞ্চাশের দশক। বন্যা, মারী, মড়ক, দুর্ভিক্ষের পূর্ববাংলা যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের এই অঞ্চলের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলার ফলে নতুন একটি শব্দ আমাদের কানে এসেছিল। শব্দটি হচ্ছে রিলিফ, কৃষকদের কণ্ঠে ইলিফ প্রায়ই শুনতাম। সেই সময় পূর্ববাংলার বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে উচ্চারিত হতো রিলিফ চোর। বাংলার গরিব মানুষদের নামে রিলিফ আসে কিন্তু তা পৌঁছায় না তাদের কাছে। তারপর এই রিলিফ কখনোই যথাস্থানে পৌঁছায়নি। গণমানুষের প্রচেষ্টায় যতটুকু সংগৃহীত হয়েছে তাই পৌঁছেছে গরিবের ঘরে, যা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের সময় কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে শিল্পীরা 'ভিক্ষা দাও হে পুরবাসী' বলে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে টাকা তুলতেন। সেই টাকায় লঙ্গরখানা খুলে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খিচুড়ি রান্না হতো। সেই খাদ্যে বিপন্ন মানুষের একাংশ জীবনধারণ করত। অবশ্য বিয়াল্লিশের মন্বন্তর ছিল মানুষের সৃষ্টি। প্রকৃতি সুজলা, সুফলা। ওই বছরই ধান উৎপাদন হয়েছিল রেকর্ড পরিমাণ। তখনকার ব্রিটিশের রাজত্বে প্রজাদের প্রতি অবহেলা এবং বিত্তবান মানুষের জন্য প্রশ্রয় মন্বন্তরকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। এই পটভূমিতে লেখা হয়েছিল বিভূতিভূষণের উপন্যাস 'অশনি সংকেত', বিজন ভট্টাচার্যের নাটক নবান্ন। তখনকার ভারতীয় গণনাট্য সংসদ অনেক কালজয়ী গান ও নাটক নিয়ে সারা বাংলা ঘুরে বেড়িয়েছেন।
ব্রিটিশের কাছ থেকে তৎকালেও স্বাধীনতা পেয়ে ওই শিল্পীরাই বলে উঠলেন- 'ইয়ে আজাদী ঝুট হ্যায়, লাখো ইনসান ভূখা হ্যায়।' সদ্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আচরণেও একই সত্য প্রকাশ হলো। এও এক স্বাধীনতা ফাঁকি। যা হোক, এরপরও অনেক রিলিফ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রিলিফ এসেছে। কিন্তু এই রিলিফ যথার্থ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। এবার মানবজাতির ইতিহাসে এক নতুন রিলিফ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এই রিলিফ বাহাদুররা মুক্তিযুদ্ধের পরও সারাবিশ্বের মানুষদের পাঠানো রিলিফ নিয়েও দুর্নীতি করেছে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও সেই পরিস্থিতিতে হতাশ হয়েছেন। সেনা শাসনের সময়ও বন্যায়, দুর্ভিক্ষে এই দুর্বৃত্তরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। বাজারে প্রচুর মজুদ আছে, সরকার দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থাও করছে। কিন্তু ত্রাণের চালের বস্তা পাওয়া যাচ্ছে আবারও ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের গুদামে। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে তারা ইতিহাসের সেই জঘন্যতম কাজটি করেই যাচ্ছে। মিডিয়ার কল্যাণে সেসবের ছবিও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এবারও সেই ১৯৪২ সালের মতোই প্রকৃতি সুন্দর।
ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ধান কাটার মৌসুম। এমনিতেই কৃষিকাজ আর লাভজনক নয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই পাওয়া যায় না কৃষি শ্রমিক। পেলেও তার উচ্চমূল্য। সেই উচ্চমূল্যের শ্রমিক দিয়েই ধান কাটতে হয়। তারপর যখন সেই ধান বাজারে বিক্রি করতে যায় একেবারেই তখন দাম পাওয়া যায় না। নিঃস্ব কৃষক এখন অশ্রুজলে তার বুকের ধনকে বিক্রি করে দিতে হয়। সরকারের ভর্তুকি দিয়েই এই ধান কেনার বিষয় আছে। কিন্তু ফড়িয়া ও কৃষি বিভাগের দুর্বৃত্তদের কারসাজিতে সেই অর্থ পৌঁছায় না তাদের কাছে। এই নিষ্ঠুরতা চলছে বহুদিন ধরে। সমস্যাটি সরকার জানে ভালো করেই; কিন্তু কোনো প্রতিকারের পথ বেরিয়ে আসছে না। এই যে মধ্যস্বত্বভোগী একটা বিষয় সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে, কালে কালে তার মধ্যে আরও ডালপালা গজিয়েছে। যে সবজির দাম কৃষক পাচ্ছেন এক টাকা, রাজধানীতে তা বিক্রি হচ্ছে দশ-পনেরো টাকায়। যুক্তিটা হচ্ছে, পরিবহন খরচ বাবদও নানা ধরনের চাঁদাবাজি আছে। এই চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত সরকারি দলের লোক এবং পুলিশ। এগুলোর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নৌ ও সড়ক পরিবহনে মালিক ও শ্রমিক একাট্টা হয়ে সরকারি দল ও পুলিশকে চাঁদা দিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণও করে থাকে এরাই। হঠাৎ করেই দেখা গেল সরকার নির্ধারিত গরুর মাংসের দাম পাঁচশ' টাকা থেকে সাতশ' টাকায় হয়ে গেল। রাষ্ট্রের একটা বড় দায়িত্বই হচ্ছে নাগরিকদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ করা। যাতে মানুষ খেয়ে বাঁচতে পারে। সব দেশেই এ ব্যাপারে নানা আইনকানুন আছে। তারপরও সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা। মুনাফা ছাড়া এই ব্যবসায়ীরা কোনো নৈতিকতার ধার ধারে না। শিশুখাদ্যে এবং প্রাণরক্ষাকারী ওষুধেও তারা ভেজাল দিতে কার্পণ্য করে না। আর এ দেশের ভোক্তারাও যথেষ্ট সহনশীল। বাসের ভাড়া, লঞ্চের ভাড়া, রিকশা ভাড়া সবই বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ করে লাভ হয় না, কারণ এসব যানবাহনের মালিকের সঙ্গে আছে ক্ষমতাশীনদের যোগাযোগ। ঈদের সময় ভাড়া বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, কোনো সভ্য দেশে এটা অসম্ভব; কিন্তু আমাদের দেশে ঈদের আগে দ্বিগুণ ভাড়া হয়ে গেল, কোনো ব্যবস্থা নেই।
প্রধানমন্ত্রী এবার যেভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল এবার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। কিন্তু কে শুনেছে এই হুঁশিয়ারি। শুধু তাই নয়, হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও তার পক্ষে দাঁড়াবার লোকের অভাব নেই। এ দেশে ভালো মানুষের পক্ষে ন্যায্য কারণেও দাঁড়ানোর লোক নেই; কিন্তু খারাপ কাজে খুব দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এবার এই করোনাভাইরাসের কালে যে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে তার যে শেষ কোথায় জানি না। সেই অনিশ্চয়তার কালেও রিলিফের চাল চুরির মতো কাজটি যারা করতে পারে তাদের পক্ষে যে কোনো কাজ করাই কঠিন নয়। তবে বলব, এই একটা সুযোগ সমাজকে একটা ন্যায়নীতি বোধের মধ্যে নিয়ে আসা। দুর্বৃত্তদের শাস্তি দিতেই হবে এবং সে শাস্তি দ্রুত পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু শতকরা একশ'ভাগ লোকই করোনা আক্রান্ত তাই জনগণকে সত্যের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার এই তো সময়। আর এই কাজটির নেতৃত্বে থাকতে হবে তাদের ওপর, যারা ন্যায়নিষ্ঠ। দুর্বৃত্তদের নেতৃত্বে এ কাজটি হবে না। অদূর অতীতেই স্কুল ছাত্রছাত্রীরা যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তেমনি খাঁটি প্রবীণ-তরুণদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।
সভা-সমাবেশের ফাঁকা বুলি নয়, একেবারেই তা হতে হবে চেতনাভিত্তিক। গত দু'দিন আগে সকালে দেখলাম বাসদ মানবতার একটা বাজার শুরু করেছে। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাখা আছে বাজারে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য সবাই বিনামূল্যে নিয়ে নিচ্ছে। কেউ বেশি নিচ্ছে না। এ এক অভিনব ব্যবস্থা। আবার বাড়ি বাড়ি গোপনে একদল মানুষ ত্রাণ বিতরণ করছে। টিভি ক্যামেরার সামনে ত্রাণ দেওয়ার ব্যাপারটি আর নয়। নয় ফেসবুকে ছবি তোলা। এসবের এক ব্যতিক্রমী আয়োজনে রিলিফ দেওয়ার বিষয়টিও উঠে আসুক। যারা মানুষকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছে তারা সত্যি মুক্তিযোদ্ধা আর যারা সেখান থেকে চুরি-চামারি এবং ঠকানোর কাজে লিপ্ত তাদেরকে রাজাকার বলেই চিহ্নিত করতে হবে।
নাট্যাভিনেতা, লেখক, নাট্য নির্দেশক
মন্তব্য করুন