আমি একজন শৌখিন কৃষক। রাজউক থেকে বরাদ্দ পাওয়া উত্তরা দিয়াবাড়ীর ৫ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি একটি ফল ও সবজি বাগান। বিগত দুই বছরের নিবিড় পরিচর্যায় আমার বাগানটি মৌসুমজুড়ে সবজিতে প্রায় ভরে থাকে। নিজের পরিবারের চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ মিটে যায় বাগানের সবজিতে, বন্ধুবান্ধবকেও বিতরণ করতে পারি। এতে যে কি পরিতৃপ্তি তা বুঝিয়ে বলার নয়। আমার নিজ হাতে বাগান পরিচর্যায় বাসার লোকজন, ড্রাইভার এবং গৃহকর্মী আমার মতোই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে এক মাস আগে শেষ যেদিন বাগানে গিয়েছিলাম সেদিন গাছে আম, জামরুল, লেবুর সমারোহ দেখেছি। শখের কাজটি করতে পারছি না বলে আমার বেদনা আকাশচুম্বী হলেও এ বাগানের ওপর আমার রুটিরুজি নির্ভর করে না।

বলছি সেই কৃষকের কথা, যার জীবন-জীবিকার সবটুকুই কৃষিনির্ভর। যার সচল হাত দিয়ে উৎপাদন ও সরবরাহ না হলে কৃষিপণ্যের অভাবে দেশে দেখা দিত খাদ্য সংকট। তাই তো সংকটের সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো কৃষক যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে।

প্রণোদনার মেয়াদ নিয়ে রয়েছে নানা কথা। এটা হতে হবে স্বল্প, মধ্যম বা দীর্ঘমেয়াদি। তবে বর্তমান বাস্তবতায় কৃষির প্রণোদনার অপেক্ষার কিন্তু সময় নেই। এ মুহূর্তে কৃষকের মাঠে শুধু ধান নয়, গ্রীষ্ফ্মকালীন শাকসবজি, ফল-ফসল সবই আছে। আছে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস এসবও। কিন্তু আহরণ ও বাজারজাতকরণে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে কৃষকের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ফড়িয়া, দালাল নামীয় মধ্যস্বত্বভোগীরা বেরোতে পারছে না, কৃষক নিজেও পণ্য নিতে পারছে না হাটবাজারে। রয়েছে পরিবহন ও ক্রেতা সংকট। ফলে শাকসবজি খাওয়ানো হচ্ছে গরু দিয়ে অথবা পচে নষ্ট হচ্ছে। তাই সার, বীজ এবং নগদ অর্থ সহায়তা নয় বরং এই মুহূর্তে কৃষকের জমি থেকে ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য কিনে কৃষককে সরাসরি যে প্রণোদনা দেওয়া যায় তার ভীষণ প্রয়োজন।

কৃষিপণ্য বা শাকসবজি মাঠে পচে যাওয়া, গরুকে খাওয়ানো, ফেলে দেওয়া- সবই ঘটে চলেছে বাজারজাত করতে না পারায়। এই চলমান সংকট তো শুধু কৃষকের নয়, ভোক্তারও। সময়মতো কৃষিপণ্য বাজারে আসছে না বলেই ঢাকাসহ অন্যান্য বড় জেলা শহরে শাকসবজির আকাশচুম্বী দাম। অন্যদিকে মুরগি আর ডিম নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা নেতিবাচক ধারণা। করোনা সংকটকে কি বাড়িয়ে দিতে পারে মুরগি আর ডিম? শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নানা খাবারের তালিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রোটিন বা আমিষ ছাড়া শরীর করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কীভাবে? গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বাজারজাত করতে না পেরে কৃষক ১/২ দিন বয়সের মুরগির বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে- ভাবা যায় কী নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত! দুধ বিপণনে পরিবহন সমস্যাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সহজেই অনুমেয় এ মুহূর্তে ন্যায্যমূল্যে কৃষকের দোরগোড়া থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ তাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। অন্যান্য মেয়াদি প্রণোদনার কথা না হয় কিছু পরে ভাবলেও চলবে। তবে কাজটি কীভাবে করা যায়? জেলা প্রশাসন তো মাঠেই রয়েছে, কাজও করছে। আরও রয়েছে পুলিশ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, সেনাবাহিনী। এসব বিভাগ নিয়োজিত রয়েছে ত্রাণকার্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সমন্বিতভাবে কাজটি করার ক্ষেত্রে তেমন বাধা দেখি না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিস্তৃতি ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যন্ত। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএডিসি সব জেলাতেই কাজ করে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে উপজেলা পর্যন্ত। কমবেশি এসব বিভাগের রয়েছে বিভিন্ন ক্যাপাসিটির যানবাহন ও পরিবহন সুবিধা। প্রয়োজনে পরিবহন সেবা ক্রয়ও করা যেতে পারে।

কৃষককে বাঁচানোর লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি প্রণোদনার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায়- ১. বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে উপজেলা পর্যায়ে একটি 'বিপণন-ক্রয় কমিটি' গঠন করা যেতে পারে; ২. মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা জানেন কোন কোন কৃষকের মাঠে কী কী ফসল রয়েছে। সরাসরি তাদের মাঠ থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনা এবং বাজারজাত-গুদামজাত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; ৩. মুরগি, ডিম, দুধ নিয়ে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে, তা নিরসনে জনসচেনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে; ৪. ক্রয়কৃত সব কৃষিপণ্য নিজ নিজ দপ্তরের আউটলেট থেকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; ৫. ঢাকায় বিপণনের ক্ষেত্রে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বিএডিসি আউটলেট ব্যবহার করা যেতে পারে; ৬. কৃষিপণ্য সংগ্রহ, পরিবহন, বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা হচ্ছে বলে কৃষকদের অভিযোগ রয়েছে। এসব বাধা দূরীকরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট আদেশ থাকা প্রয়োজন।

শুরু করেছিলাম নিজের ছোট্ট সবজি বাগানের কথা দিয়ে। গত এক মাস সেখানে সেচসহ কোনো পরিচর্যাই করা সম্ভব হয়নি। ক্ষণে ক্ষণে তাই বয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস। ভাবছি সেই কৃষক ভাইয়ের কথা, যার চোখের সামনে তারই উৎপাদিত ফসল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মুরগির ছানাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতে হচ্ছে। তার অনিশ্চিত জীবন-জীবিকার কাছে আমার সামান্য একটি দীর্ঘশ্বাস কতই না ক্ষুদ্র!

সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ ও অনুষদ সদস্য, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা