করোনাদুর্যোগের এ সময়ে দেশে সবার সামনে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা স্পষ্ট হয়েছে। এর পেছনে অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম যেমন রয়েছে তেমনি জনবলের ঘাটতিও কম দায়ী নয়। রোববার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, '৩০ হাজার পদ খালি স্বাস্থ্য বিভাগে।' এটি চিকিৎসক ও নার্সের বাইরে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী যেমন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তাকর্মী, ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির হিসাব। অথচ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নতুন করে কেবল দুই হাজার চিকিৎসক ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগের কথাই বলেন। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগে এসব কর্মীও অত্যন্ত জরুরি। আমরা জানি, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের কাজ যেমন চিকিৎসক কিংবা নার্স করতে পারবেন না- একইভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ড্রাইভারের কাজও অন্যরা করতে পারবেন না। সুতরাং প্রত্যেকটি কাজের জন্য পৃথকভাবে জনবল নিয়োগের প্রয়োজন।

এ সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার যে যুক্তিতে চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, ঠিক একই যুক্তিতে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ করোনাভাইরাসে চিকিৎসক ও নার্সের বাইরে প্রায় সমসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে দেড় হাজারের বেশি চিকিৎসক-নার্সের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, মহামারি মোকাবিলায় কাক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক-নার্সের পাশাপাশি অন্যান্য জনবলেরও আনুপাতিক হারে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। আমরা জানি, জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। আবার স্বাস্থ্য খাতে যারা কর্মরত রয়েছেন, তাদের ঠিকমতো দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনেক চিকিৎসক কর্মস্থলে থাকেন না বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সেটিও দেখতে হবে। নতুন জনবল যেমন নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন তেমনি বর্তমান জনশক্তিও ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটা তদারকি দরকার।

আমরা বিস্মিত, স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ এত পদ বছরের পর বছর ধরে কীভাবে খালি পড়ে থাকে! সমকালের সংশ্নিষ্ট প্রতিবেদনে এসেছে, আইনি জটিলতার কারণে বছরের পর বছর ধরে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছিল না। বছর দেড়েক আগে সেই বাধা দূর হলেও এখন পর্যন্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া যায়নি। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় এবং সেখানে সাড়ে সাত লাখের মতো আবেদন জমাও পড়ে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেমে যায়। এখন মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যেমন দ্রুত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিচ্ছে, তেমনি চাইলে দ্রুত এসব পদেও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এতে যেমন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, তেমনি হাজার হাজার বেকার যুবকের ভাগ্য বিড়ম্বনারও অবসান হবে।

এটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বোঝা যায়, স্বাস্থ্যসেবা শুধু চিকিৎসক ও নার্স দিয়েই হবে না। এর সঙ্গে অন্যান্য কর্মীও জরুরি। চিকিৎসক-নার্সরা নিশ্চয়ই বাড়ি বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করবেন না। হাসপাতাল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও ট্রলি বহন করাসহ অন্যান্য কাজ যারা করেন, তাদের সবার সেবা মিলেই স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। করোনায় তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে তাদের নিয়োগের বিষয়টিও ভাবতে হবে। এখন জরুরি হিসাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য তো বটেই, স্বাভাবিক সময়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতেও স্বাস্থ্যকর্মীর এসব পদ খালি থাকা মেনে নেওয়া যায় না।

আমরা জানি, স্বাস্থ্য অন্যতম মানবাধিকার এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানব উন্নয়ন সূচক। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বাস্থ্যসেবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত নানা দিক থেকেই অবহেলিত রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বাজেট অপ্রতুল, জনবল সংকট, অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা এখানে স্পষ্ট। সরকার উন্নয়নে জোর দিচ্ছে এটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু উন্নয়নের জন্য মানুষের যে সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন তা স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব। করোনা-দুর্যোগ আমাদের যেভাবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা দেখিয়ে দিচ্ছে, তাতে সরকারের উচিত হবে নতুন করে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো। এক্ষেত্রে জনবল সংকট কাটাতেই হবে। আমরা চাই ত্রিশ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের বিষয়টি স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকারে থাকুক। এমনকি যখন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে তখনই একসঙ্গে এসব স্বাস্থ্যকর্মীর পদগুলো পূরণ করা যায় কিনা ভাবা যেতে পারে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাও দূর করা চাই। এর মাধ্যমেই স্বাস্থ্য খাতে গতি আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।