মানবসমাজ অত্যন্ত কঠিন, সংকটময়, অনিশ্চিত, ভীতিকর সময় অতিক্রম করছে। করোনাভাইরাসের অভিশাপ শুধু আমাদের প্রিয় দেশটিকেই নয়, সমগ্র বিশ্বের মানবসমাজকে বিপন্নতার সীমানায় ঠেলে দিয়েছে। মানুষকে অসহায় ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন দুর্দৈবের মুখোমুখি হয়নি মানবজাতি। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই দুর্দম শত্রুকে পরাস্ত করতে না পারলে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অপরাজেয় অভিশাপরূপে দেখা দেবে। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যাও। উদ্বেগজনক বার্তা পাওয়া গেল যে, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় করোরই যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না।
এই শত্রুকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করুক চিকিৎসা বিজ্ঞান। মানুষের সৃজনশীলতার বিজয় হোক- এটাই প্রত্যাশা করছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন- প্রথমত চারটি ওষুধ ও আরও কয়েকটি ওষুধের সমন্বিত প্রয়োগ সম্পর্কে কাজ চলছে। তিনি আরও বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের জন্য টিকা আবিস্কারের প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। মানবের সৃজনশীলতা অতীতে যেভাবে ভয়ংকর রোগ-ব্যাধির ওপর বিজয় অর্জনে সফল হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও তাই হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই নতুন শত্রুকে দমন করতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। ততদিনে আরও যে লোকক্ষয় হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি সচেতন হই এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, তাহলে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মেনে চলার জন্য পুলিশের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরও। কেননা, রাষ্ট্রের জন্য তাদেরও সুস্থ থাকা প্রয়োজন। তারাই-বা কেন করোনার মধ্যে ঢুকে পড়বেন? জনগণকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি করবেন জননেতারা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এ মুহূর্তে তাদের মধ্যে ঐক্য দরকার সর্বাগ্রে। সাধারণ মানুষকে তারা সচেতন করবেন। কর্মহীন ও খাদ্য সংকটে পড়া মানুষদের সহায়তা করবেন। ত্রাণসামগ্রী, ওএমএসের চাল চুরির যেসব চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়; যুগপৎ বিস্ময়করও।
এখন প্রয়োজন সাধারণ জনগণের মধ্যে যারা দিন আনেন, দিন খান তাদের খাদ্যের সংস্থান আরও জোরদার করা। জনগণের এই অংশকে রাষ্ট্রের উচিত- খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য যা প্রয়োজন তা সরবরাহ করে সুস্থ রাখা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তৈরি রাখা, যেন এই সংকট কেটে গেলে তারাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়েন। বিদ্যমান সংকটে সম্মিলিত প্রয়াসই দিতে পারে স্বস্তির ঠিকানা। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্য গড়ে দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন সমন্বিতভাবে। আমরা যেন ভুলে না যাই- মানুষ মানুষের জন্য। এই মুহূর্তে মানুষ বড় অসহায়, বিপন্ন। আশঙ্কা ও মৃত্যুভয় অনেককেই ঘিরে ধরেছে। তাদের অভয় দিতে রাজনীতিক ও সমাজের সচেতনদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর উন্মত্ততা থেমে গেলে বিশ্বময় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে, যেমন হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও। ওই বৈপ্লবিক পরিবর্তন জনসমাজে, বিশ্বসমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে সদ্য আবিস্কৃত আণবিক বোমা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে; অসংখ্য মানুষকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ভয়ংকর মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয় যে অস্ত্র দিয়ে, তা সমগ্র পৃথিবীটাকে কমপক্ষে ১৪ বার ধ্বংস করা সম্ভব। উত্থান ঘটে বিশ্ব দুই পরাশক্তির; যদিও দুই পরাশক্তির সঙ্গে বিজয়ী জোটের সদস্য ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পরবর্তীকালে চীনকে ভেটো ক্ষমতা দান করে বিশ্বে শান্তিরক্ষার জন্য একটি কাঠামোও তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স এসব ঔপনিবেশিক শক্তির ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থা এবং উপনিবেশে জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় বটে; কিন্তু নয়া উপনিবেশবাদের প্রভাবে জনগণের স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হয়নি। গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হয়। বিশ্বে সে রকম কিছুই আমরা কি প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি? এই জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে সময় লাগবে।
করোনাভাইরাসের সমাপ্তিলগ্নে জনগণের সচেতন এবং সজ্ঞাত পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের নিজেদের, সঙ্গে সঙ্গে সবার আত্মরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মধ্যে যে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে যে নতুন বিশ্ব আত্মপ্রকাশ করবে, তা আকারে-প্রকারে পুরোনা বিশ্ব থেকে যে স্বতন্ত্র হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সে রকম পরিস্থিতির ইঙ্গিত এরই মাঝে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। তবে আপাতত বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে ওঠাই কঠিন হয়ে পড়েছে। মানবসভ্যতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সংকট। সংকট-উত্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা শুধু ধারণা করতে পারি কিন্তু চূড়ান্ত কথাটা বলা মুশকিল; যা বলা হয়েছে, তা সবটাই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে পাল্টেছিল, করোনাভাইরাস নির্মূল হওয়ার পরও আজকের বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিও পাল্টে যেতে বাধ্য। এই পরিবর্তন মানবসমাজের জন্য নতুন এক দিগন্তেরও উন্মোচন করতে পারে। দেশে দেশে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা-হিংসার উন্মত্ততা থেমে শান্তিময় বিশ্বের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারে। আমার ধারণা, যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিশ্ববাসী দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছিল, তা পরিণত হওয়ার দিন আসছে তিক্ততম, ভীতিকর, নির্মম করোনাভাইরাস বিজিত হওয়ার পরেই। এর লালনকারী হিসেবে ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা যে সুযোগ পেয়েছিল, তা তারা কাজে লাগাতে পারেনি। খুব সম্ভব সেই দায়িত্ব গিয়ে পড়বে চীনের ওপর। অবস্থা যা-ই হোক, বোধ করি শেষ পর্যন্ত জনগণেরই বিজয় সূচিত হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এও সত্য, লোকক্ষয়ের যে মর্মন্তুদ অধ্যায়ের এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা মানবসভ্যতার জন্য কঠিন দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
আমার মনে হয়, সামনে সমাজ পরিবর্তনের স্রোত আসছে। বিশ্বের দেশে দেশে এই পরিবর্তনের ঢেউ লাগবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। করোনায় বর্তমান বিশ্ব সমাজ গতি হারিয়েছে সত্য। তবে ভিন্ন চরিত্রে তা ফিরেও আসবে। বিশ্ব মানবসমাজে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। আমরাও এর বাইরে থাকব না। পরিবর্তনের এই স্রোতধারা আমাদের বুঝতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়