কথাশিল্পী শওকত ওসমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে। লেখা পড়ার শুরু জুনিয়র মাদ্রাসায়। সেকালের মাদ্রাসার একটি ছেলে পরে কী করে আপন মহিমায় এমনি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, তা ভাবতেই অবাক লাগে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন অকুতোভয়ে। প্রথমবার প্রহূত হয়েছেন আল্লামা ইকবালের স্মরণ অনুষ্ঠানে।

এরপর ১৯৬২ বা '৬৩ হবে, কথাশিল্পী শওকত ওসমান তখন 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ওই বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যিক হিসেবে কথাশিল্পী শওকত ওসমান তখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এই আদমজী পুরস্কার আনার জন্য তৎকালীন জিন্নাহ্‌ অ্যাভিনিউর 'ডোরিনা' টেইলারিং শপ থেকে স্যুট তৈরি হলো।

ঢাকা কলেজের শিক্ষক কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে এই পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল জালাল উদ্দিন স্যারের সহযোগিতায় ছাত্র সংসদ সংবর্ধনার আয়োজন করে।

কথাশিল্পী শওকত ওসমান তখন সমাজে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এক লেখক।

ঢাকা কলেজে শিক্ষকতার কারণে পরীক্ষার হলে ডিউটি পড়েছে কথাশিল্পী শওকত ওসমানের।

ডাকা মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের ফাইনাল পরীক্ষা।

মেডিকেলের ছাত্ররা এ পরীক্ষা পাস করলেই ভাইভা ও পরে ডাক্তার হয়ে মানবসেবায় নিজেদের উৎসর্গ করবে। মহতী এক পেশাকে আলোকিত করবেন এসব টগবগে তরুণ। কেউ হবেন ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের মতো যশস্বী ডাক্তার। আবার এখান থেকেই জন্ম নেবে ডা. নন্দীর। এরাই হবেন মহান চিকিৎসক ইবনে সিনার উত্তরসূরি।

চারদিকে নিশব্দতা। কেবল খস খস লেখার শদ। লেখার শব্দ ছাড়া ইথারে আর কোনো তরঙ্গ নেই। ডাক্তার মানে সব মেধাবী ছাত্র। পূর্ব-পাকিস্তানের বাছা বাছা তুখোড় সব শিক্ষার্থী। ফার্স্ট-সেকেন্ডের মাঝে নাম্বারের ফারাক খুবই কম থাকে। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই।

হঠাৎ একি!

যে ছেলেরা ডাক্তার হবে তারা কাগজে নকল এনে টুকছে! টুকলিফাই!

ষাটের দশকে এমন এক সমাজ বিরাজ করছে, তখন নকল তো দূরের কথা, নোটবই পড়াটাকে ঘেন্নার চোখে দেখা হতো। সেই সমাজে নকল। তাও আবার কথাশিল্পী শওকত ওসমানদের মতো সৎ আদর্শবান মানুষের সামনে! ভাবাই যায় না।

কথাশিল্পী শওকত ওসমান হাতেনাতে নকলবাজ ছাত্রকে ধরলেন। কেড়ে নিলেন নকলের টুকলিফাইয়ের চোথাটা।

ব্যস সঙ্গে সঙ্গে হৈ হুল্লোড়, হৈচৈ। ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশনের ( এনএসএফ) বখে যাওয়া নোংরা মানসিকতা সম্পন্ন তথাকথিত নোংরা পরিবারের মেডিকেল ছাত্ররা সব, নকল ধরা চলবে না, চলবে না বলে চেঁচামেচি হৈচৈ শুরু।

অন্যান্য রুম থেকেও ছাত্র-শিক্ষকরা এসে হাজির। ব্যাপার কী?

নকল কেন ধরেছেন, মার শালা কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে, শুরু হলো কিল-চড়-ঘুষি। মেডিকেল ছাত্র বনাম শিক্ষকদের হাতাহাতি।

কেমন করে যেন ঢাকা কলেজের সাধারণ ছাত্ররা জেনে গেল তাদের সবার প্রিয় শিক্ষক কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে মেডিকেলের ছাত্ররা মেরেছে।

মৌচাকে ঢিল। দলে দলে সাধারণ ছাত্ররা এসে মেডিকেলের ছাত্রদের মাইর। মাইরের চোটে মেডিকেলের ছেলেরা রক্তাক্ত অবস্থায় জান নিয়ে নিউমার্কেটের দিকে পালাল।

অচেতন কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে ধরাধরি করে শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল জালাল উদ্দিন স্যারের কোয়র্টারে নিয়ে মাথায় পানি ঢালল।

পরীক্ষা ভন্ডুল। সালটা ১৯৬২ কি ১৯৬৩।

হবু ডাক্তারের দৌরাত্ম্যে কেবল নকল ধরতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় কথাশিল্পী শওকত ওসমান প্রহূত।

এ তো গেল মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের, এনএসএফের বখে যাওয়া ছাত্রদের হাতের প্রহার।

কিন্তু কথাশিল্পী শওকত ওসমান জীবনের শেষ অঙ্কে এসে মারটা খেলেন তথাকথিত হোয়াইট কলার জবের হাতে।

ঘটনাটা সিম্পল।

প্রায় একুশ বছর পর আবার জনগণ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবার সুযোগ প্রদান করে। উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে কথাশিল্পী শওকত ওসমান একমাত্র বুদ্ধিজীবী, যিনি ঘৃণাভরে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন।

চলচ্চিত্র নির্মাতা