এই শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া শিশুরা কোনো মহামারি তো দূরে থাক, জাতির জন্য চরম সংকটময় পরিস্থিতিতেই তাদের পড়তে হয়নি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট দেশব্যাপী যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তার ভয়াবহতা ছিল অবর্ণনীয়। তাদের সেই জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতার শিকার হয়েছে শিশুরাও। শিশুদের পড়ালেখা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু এই বৈশ্বিক মহামারির তুলনায় শিশুদের তা কমই স্পর্শ করতে পেরেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তার অনিশ্চয়তা এত দীর্ঘমেয়াদি ছিল না।

কিন্তু কভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছে, তাতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিশুর ভবিষ্যৎ পৃথিবী। তাদের কোলাহলমুখর বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, ক্লাসরুম, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি, প্রতিদিনের নতুন অভিজ্ঞতা, শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিদিনের আলাপচারিতা, পাঠপরিক্রমা সবই বদলে গেছে। নগর শিশুর ক্লাসরুম, পরীক্ষার খাতা, বাড়ির কাজ এবং ক্লাসের পড়া- সবই এখন একটি কম্পিউটারে বন্দি হয়ে গেছে। তাদের গল্পের বইও এখন কম্পিউটারে। বিনোদন মানেই তো এখন কম্পিউটার, ইন্টারনেট।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই শিশুরা তো ভালোই আছে। কিন্তু তার শিশুমনে যে সারাক্ষণ বয়ে চলে নানা অনিশ্চয়তার ঝড়, নানা জিজ্ঞাসা। তার কোনো জবাব এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। কবে সব স্বাভাবিক হবে, কবে স্কুল খুলবে, কবে আবার সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুরতে যাবে কিংবা আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে- এসব প্রশ্নের জবাব তো আসলে কারও জানা নেই।

তবুও এই অনিশ্চয়তায় ভরা শিশুমনটিই কিন্তু আরেকজনের জন্য ভাবছে। ভাবতে পারছে। এই মহামারি তাদের সংবেদনশীল মনকে জাগিয়ে দিয়েছে। যে শিশুটি নিজের একটি শখ পূরণ করার জন্য বছর ধরে মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়েছে, টিফিনের টাকা বাঁচিয়েছে সাইকেল কেনার জন্য, তারাই কিন্তু এই দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছে মানুষের পাশে। পিরোজপুরের মিনা শিশু নিকেতনের শিশু শিক্ষার্থীদের মাটির ব্যাংকের জমানো টাকা এবং জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মওদুদ হোসেনের টিফিনের টাকার সঞ্চয় সরকারি ত্রাণ তহবিলে দান করার ঘটনা আমাদের সেই বার্তাই দেয়।

১২ বছরের কিশোর মাধুর্য বলে, 'মা আমার ১২ বছরের জীবনে ২৪টি ঈদ পেলাম। তার দুটো ঈদই তো নষ্ট হয়ে গেল।' গত বছর বড় বোনের ক্যান্সার চিকিৎসায় মা-বাবা দেশের বাইরে ছিলেন। আর এ বছর করোনায় পৃথিবীব্যাপী মানুষ মারা যাচ্ছে। কত মানুষ খেতে পাচ্ছে না। তাহলে ঈদ কেমন করে হবে। গত বছর মাধুর্য মা-বাবাকে ছাড়া ঈদ করেছে। এবার মা-বাবা পাশে আছেন। কিন্তু এখন তো আর নতুন জামা পরে ঈদ করা যাবে না। সে মাকে বলেছে, তার ঈদের জামার প্রয়োজন নেই। মাধুর্য এ বছর তার ঈদের জামা কেনার টাকা দিয়ে কাউকে সাহায্য করবে। আবার নবম শ্রেণির ছাত্র সাম্য প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে গিয়ে রিকশাভাড়া থেকে এক হাজার টাকা জমিয়েছিল ঈদে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে বলে। সেই টাকাই দিয়ে দিল বন্ধুর বাড়িতে বাজার করার জন্য।

ছোট ছোট মানুষের এই বড় বড় উপলব্ধিই এখন আমাদের সম্বল। এই উপলব্ধিগুলোকে জাগিয়ে রাখতে হবে। এখন রমজান মাস। আর ক'দিন পরই ঈদ। রমজান মাসের ইফতার, সেহরি এবং ঈদের কেনাকাটাকে ঘিরে মানুষের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কারও কাছে রোজায় মনমতো বাহারি ইফতার খেতে না পারাটা বেদনার। কেউ আবার ঈদের কেনাকাটা করতে পারবেন না বলে হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু আপনার শিশুসন্তানটিকে জিজ্ঞেস করুন তার কাছে এই মুহূর্তে ঈদের কেনাকাটা আনন্দের? নাকি বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে খেলতে যাওয়াটা আনন্দের? আমার বিশ্বাস, তারা দ্বিতীয়টিকেই বেছে নেবে। আর যাতে তাড়াতাড়ি আবার স্কুলে যেতে পারে, তার জন্য সবার সুস্থতা এবং সামাজিক দূরত্ব মানাটা কত জরুরি, সেটা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদের বলতে হবে, এই মুহূর্তে ঈদের কেনাকাটা শুধু অনেকগুলো টাকার ব্যাপার নয়। এটি এখন স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকি। এই সময়ে সারাবিশ্বে কত মানুষ মারা যাচ্ছে, কতজন খেতে পাচ্ছে না, এসব নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাদের জন্য আমাদের কী করা দরকার, এই সিদ্ধান্তের ভার তাদের ওপরই ছেড়ে দিন। দেখবেন আপনার মনের ওপর থেকে বোঝা নেমে যাবে। সে নিজেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। শিশুদের বোঝাতে হবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এটাই সময়। তাদের উর্বর মনোভূমিতে সহানুভূতির একটি চারা লাগানোই যথেষ্ট। বাকি পরিচর্যা সে নিজেই করে নেবে।

সাংবাদিক