অদৃশ্য আর অতি ক্ষুদ্র কভিড-১৯ ভাইরাস ক্রমে গোটা পৃথিবী করায়ত্ত করে নিচ্ছে। মানুষের তৈরি করা ভেদাভেদের কোনো সীমাই মানছে সে। এতদিনকার অহংবোধ আর দম্ভ কেমন ভেঙেচুরে একাকার করে দিচ্ছে। অর্থেবিত্তে শক্তিধর যেসব দেশ, যারা দুনিয়াটাকে শাসন করছে, রেহাই দিচ্ছে না তাদেরও। এমনকি বেশি যাদের মারণাস্ত্র আছে, তাদেরও কেয়ার করছে না। অন্য দেশের মানুষদের যারা প্রতিনিয়ত মারছে নানা রকম অস্ত্র দিয়ে, তারাও এর বিরুদ্ধে রা পর্যন্ত করছে না। কেবল মৃত্যু নয়, যেন অন্য আরও কোনো বার্তা নিয়ে এই নশ্বর ধরাধামে হাজির হয়েছে খুদে এই জীব কণিকাটি।

মানব ইতিহাসে মৃত্যুর খবর নতুন কিছু নয়। এমনকি লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও আমাদের অজানা নয়। মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষকে জীবন হারাতে হয়েছে আমাদের দেশটাতেই। গত শতাব্দীর তেঁতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের কথাটাই ভাবুন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে কোন ফসলটা আমাদের কৃষক ফলাবেন সে অধিকারটা পর্যন্ত তাদের দেওয়া হয়নি। শাসকদের ইচ্ছায় তখন ফলাতে হতো পাট, ইক্ষু, তামাক, তুলা, নীল এসব ফসল। বাঁচার জন্য অতি জরুরি ধান, ডাল, সবজি, তেল ফসলটা পর্যন্ত আবাদ করা যেত না তাদের চাপে পড়ে। ফলে ফি বছরই লেগে থাকত খাদ্য সংকট। সে সংকট ব্রিটিশদের ঠিক ছুঁতে পারত না। সংকট ছিল চাষাভুষা আর শ্রমজীবী মানুষের জন্য। তখন আবার শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার ওপর বার্মায় চলে এসেছিল জাপানি সৈন্যদল। অতঃপর শুরু হলো ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য খাদ্য মজুদের কাজ। ট্রেনে সৈন্য আর তাদের মালপত্র বহন অগ্রাধিকার পেল। খাদ্যবাহী নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিদেশ থেকে খাদ্য এনে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করার কোনো পদক্ষেপই নেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল। অতঃপর অনিবার্যভাবে দুর্ভিক্ষে মারা গেল ১৫ লাখ মানুষ। এক জাতির মানুষের জন্য সে ছিল এক বিভীষিকাময় দিন। মানবজাতির কণ্ঠে তখন এর জন্য দুঃখবোধ প্রকাশের ভাষাটাও প্রকাশ পায়নি।

দ্বিতীয় উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশের। ১৯৭৪ সালের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করছেন, দেশের স্ব্বাধীনতার স্ব্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া সম্ভব হলো, সংবিধান রচনা করা হলো, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলো। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন। কৃষককে দিচ্ছেন কৃষি উপকরণ আর সহজশর্তে ঋণ। এর আগে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বড় কোনো প্রকল্পই হাতে নেয়নি পাকিস্তান সরকার। ফলে খাদ্য সংকট বরাবরই ছিল এ দেশে। ১৯৭৩ সালে দেশে দীর্ঘ খরা দেখা দিল, দেখা দিল প্রলয়ঙ্করী বন্যা। তার ওপর দেখা দিল বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে খাদ্য আমদানিনির্ভর বাংলদেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিল। প্রতিশ্রুত খাদ্য আমদানি করা সম্ভব হলো না। তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যের জাহাজ আটকে দিল। তাদের অসহযোগিতার জন্য মারা গেল সরকারি হিসাবমতে ২৭ হাজার লোক। অসমর্থিত হিসাব বলে সে সংখ্যা লাখের কম নয়। যুক্তরাষ্ট্র্র তো নয়ই, বিশ্ব বিবেকে এর কোনো বড় সাড়াই পড়ল না।

কারণে-অকারণে পৃথিবীতে মরেছে মরছে কত মানুষ। কত যুদ্ধবিগ্রহ চলেছে চলছে এখনও। ব্যবহার হয়েছে, হচ্ছে কত রকম সব মারণাস্ত্র। ব্যবহারের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে কত সব আণবিক আর হাইড্রোজেন বোমা। আণবিক বোমার একটি বাস্তব পরীক্ষাও হয়ে গেছে জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। হিরোশিমা নাগাসাকিতে এর ক্ষতির ভয়াবহতার নিদর্শন এখনও খানিক রয়েছে। এমনকি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে কোনো কোনো দেশে জমা করে রাখা হয়েছে নানা রকম জীবাণু অস্ত্রও।

অণুজীব আর জীবাণু নিয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে বলেই আমরা ব্যাকটেরিয়া রোগের বিপক্ষে পেয়েছি জীবনরক্ষাকারী বহু অ্যান্টিবায়োটিক। গবেষণা শুরু হয়েছে জীব কণিকা-ভাইরাস নিয়েও। বেশ কিছু অ্যান্টিভাইরাল টিকাও আবিস্কৃত হয়েছে। এদের ব্যবহার বেশ কিছু ভাইরাসের হাত থেকেও বাঁচাচ্ছে আমাদের। সেগুলোর জন্যই বিজ্ঞান আশীর্বাদ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের চাপে পড়ে বিজ্ঞান অভিশাপের দিকেও গেছে। বিশ্বের কোনো কোনো ল্যাবে জীবাণু অস্ত্র তৈরির গবেষণা জোরদার করা হয়। জীবাণু অস্ত্র তৈরিও করা হয়। এর ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে, সে কথা না বোঝার কারণেই দেখি জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা।

কেউ কেউ অভিযোগ করলেও বলছি না যে, কভিড-১৯ একটি জীবাণু অস্ত্র। প্রমাণ না পেলে সে কথা বলা যায় না। তবে জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার কী ভয়াল রূপ নিতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ হিসেবে একে সহজেই চিন্তা করা যায়। এর থেকে দুটি বড় শিক্ষাগ্রহণের মহাসুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, পৃথিবীর বহু গবেষণাগারে এখন অণুজীব, জীবাণু এবং ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। সে গবেষণার প্রয়োজনীয়তাও আছে। নইলে আমরা নানা রকম জীবাণু আর কভিড-১৯-এর বিপক্ষে ভ্যাকসিন পাব কী করে। বরং মানুষের কল্যাণে সে গবেষণা আরও জোরদার করতে হবে এবং এ ধরনের গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, গোপনে গোপনে কোনো কোনো দেশ জীবাণু অস্ত্র বানিয়েছে কিনা বা বানানোর গবেষণা চালাচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে দেখার সময় এসেছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ আজ হোক কাল হোক আলোচনা করতেই পারে। জনমত গঠন করতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধ্বংস করতে হবে সব রকম জীবাণু অস্ত্র। গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা যখন মহাসংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন অণুজীব আর ভাইরাস নিয়ে গবেষণা কেবল মানুষের কল্যাণে হবে সে প্রত্যাশা আমাদের সবার।

কভিড-১৯-এর সংক্রমণে আরও কত মৃত্যু অপেক্ষা করছে কে জানে। মানবজাতির এই মহাসংকটে এক করুণ সুরও এর মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে। সেটি এক মহামিলনেরও সুর। যুদ্ধ আর যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে সে সুর। মানবজাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষাও ধ্বনিত হচ্ছে সে সুরে। এক মানবিক এবং কল্যাণময়ী পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায় আমরা নিশ্চয়ই সে সুরের রেশটাকে বাঁচিয়ে রাখব বহু দিন, বহু বর্ষ, বহু যুগ আর যুগের পর যুগ।

অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়